সরকার দেশজুড়ে আগুনে পোড়া রোগীদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে ঢাকার বাইরে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট স্থাপন করবে। এগুলো পরিচালিত হবে সিলেট, রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে।
পর্যায়ক্রমে এ রকম পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট আরও করা হতে পারে। আগুনে পোড়া রোগীদের অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এ ধরনের বার্ন ইউনিটে যথাসময়ে ভর্তি হতে পারে না। এ কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াসহ অনেককে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বও বরণ করতে হয়।
দেশে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে প্রায় ৮ লাখ মানুষ অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়। পোড়া রোগীদের ২১ শতাংশ ঢাকা এবং আশপাশের জেলা থেকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসে।
কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে আসা ৭৯ ভাগই গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে (দুর্ঘটনার প্রথম ২৪ ঘণ্টা) হাসপাতালে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে রোগীর ক্ষতি বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পৃথক বার্ন ইউনিট হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ‘১০০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিট’ প্রকল্পের আওতায় এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর একনেক সভায় পাঁচ জেলায় বার্ন ইউনিট স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও এ প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে সৌদি সরকার।
এ পাঁচ জেলার বাইরে চীন সরকারের অর্থায়নে চট্টগ্রামে একটি বার্ন ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি পৃথক প্রকল্পে ময়মনসিংহ ও খুলনাতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু হয়েছে আরও দুটি বার্ন ইউনিটের।
জানতে চাইলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ও এই প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নওয়াজেশ খান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বছরজুড়েই বিভিন্নভাবে মানুষ অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন। শীতকালে গ্রামাঞ্চলে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু উদাহরণস্বরূপ ঠাকুরগাঁও, রংপুর বা দিনাজপুরের মতো দূরে বসবাসকারীদের ঢাকায় এসে চিকিৎসা নেওয়া অনেক কষ্টের। এজন্য পোড়া রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব ইউনিটে ১০টি আইসিইউসহ অন্যান্য সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ও পোড়া রোগী ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কো-অর্ডিনেটর ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, ‘পোড়া কোনো রোগ নয়, এটি দুর্ঘটনা। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে এ ধরনের দুর্র্ঘটনা তত বাড়ছে।’
তিনি মনে করেন, অগ্নি-দুর্র্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জনসাধারণকে জানাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাছাড়া পোড়া রোগীর শারীরিক সমস্যা জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন। এমনও হয় যে, টানা দুই বছর চিকিৎসা নিতে হয়। টিমওয়ার্কভিত্তিক চিকিৎসা লাগে। ফলে রোগী কমানোর ওপর জোর দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা-জেলা হাসপাতালে পোড়া রোগীদের সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। পাঁচ জেলায় নতুন বার্ন ইউনিট হলে মানুষ সুবিধা পাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যদি ১৫ তলা বিশিষ্ট ৫০টা হাসপাতালও করা হয়, তাতেও লাভ হবে না। যদি না মানুষকে পোড়ার কারণ জানানোর পাশাপাশি সচেতন করা না যায়। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ওই দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ‘জাতীয় অগ্নিদুর্র্ঘটনা দিবস’ ঘোষণা করা হলে জনসচেতনতা বাড়বে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম আইয়ুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রথমত দেশের মানুষ স্ক্যালব বার্ন তথা গরম পানি, গরম তেল বা গরম কোনো তরল পদার্থ দ্বারা পোড়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রিক বার্ন অর্থাৎ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিদুর্র্ঘটনার শিকার হন। তৃতীয়ত, ফ্লেম বার্ন তথা সরাসরি আগুনের সংস্পর্শে পুড়ে থাকে যেমন : মোমবাতি, হারিকেন, চুলা বা অন্যভাবে শাড়ি, ওড়না, জামা-পাজামা বা পরিধেয় বস্ত্রে আগুন লাগা। চতুর্থত, কেমিক্যাল বার্ন তথা দাহ্য পদার্থ জাতীয় রাসয়নিকে পোড়া।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অনেকে জানান, গ্যাসের চুলা থেকে আগুনের ঘটনা প্রায় ঘটছে। এতে গ্যাস বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জীবনহানি হচ্ছে অনেকের। এছাড়া গাড়ি ও কলকারখানাতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না। নিম্নমানের এসিতেও গ্যাস বিস্ফোরণ হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ জনসচেতনতা বাড়াতে বিস্তর কর্মসূচি নিতে হবে। এর বাইরে বিশেষ করে শীতকালে নানাভাবে সাধারণ মানুষ অগ্নিদুর্র্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। কারণ এ সময় মানুষ গরম পানির ব্যবহার বেশি করে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, যে পাত্রে পানি গরম করে, সেই পাত্রই অন্যত্র নেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে চুলা ও খোলা মাঠে আগুন জ্বালিয়ে শীত উপশমের চেষ্টাকালেও দুর্র্ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে শিশু ও নারীরা দুর্র্ঘটনার শিকার বেশি হয়।
গত অক্টোবরে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে আসা ৯৮১ জন পোড়া রোগীর মধ্যে ২৯০ জন ভর্তি হন। নভেম্বরে আসা ৯৯৭ জনের মধ্যে ভর্তি হন ২৬৫ জন।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম যুগান্তরকে বলেন, শিশুদের ১০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেলে দ্রুত হাসপাতাল নিতে হবে। গোল্ডেন আওয়ার অর্থাৎ যে কোনোভাবে পুড়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া না গেলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব হয় না। পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেলে ৩০০ শয্যা রয়েছে। এর বাইরে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ৫০০ শয্যা চালু আছে। এসব উন্নত হাসপাতালে ঢাকার আশপাশের রোগীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসতে পারলেও অন্য জেলার রোগীরা পারে না।
তিনি আরও বলেন, পোড়া রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন স্টাডি গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস (রেসিডেন্সি) এবং বিসিপিএসের (বাংলাদেশ কলেজ অব ফজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) অধীনে এফসিপিএস কোর্স চালু আছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন এমএস পাশ করেছে। আগে প্রতিবছর এমএস কোর্সে ঢামেকে দুই থেকে চারজন ভর্তি হতো। এখন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ২০ জন এবং ঢামেকে ৮ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্লাস্টিক সার্জন ছিল ১৫ থেকে ২০ জন। এখন পাশ করা প্লাস্টিক সার্জন আছে ১৩৫ জন। আরও কিছু সংখ্যক অপেক্ষমাণ রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলেন, পোড়া রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এনেসথেসিস্ট ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এর বাইরে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে দক্ষ নার্স, ড্রেসার ও ফিজিওথেরাপিস্টদের। ২০১৭-১৮ সালে ঢামেক বার্ন ইউনিটের ৩০০ নার্সকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের অনেকেই বদলি হয়ে গেছে। এছাড়া ক্ষত ব্যবস্থাপনায় ড্রেসার গুরুত্বপূর্ণ হলেও পদ না থাকায় ওয়ার্ডবয় ও নার্সরা ড্রেসিং করছেন। এজন্য বার্ন ইনস্টিটিউটে ড্রেসারের ১০০টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে এখন আর্থিক অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।