নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বাদী মৌসুমিকে (২০) মুঠোফোনে ফোন দিয়ে পিবিআই অফিসে ডেকে পাঠান ইন্সপেক্টর শামীম। তিনি মৌসুমিকে বলেন, আপনার মা-বাবা সহ ৩ জন সাক্ষী নিয়ে বুধবার দুপুর ২টায় পিবিআই অফিসে উপস্থিত হবেন। কথা মতো তিনজন সাক্ষী ও মা-বাবাকে নিয়ে উপ-শহরস্থ পিবিআই অফিসে যান মৌসুমি। এসময় ইন্সপেক্টর শামীম তাকে ধমক দিয়ে বলেন, বাচ্চাতো আগেই মারা গেছে মামলা করেছেন কেন? পরে প্রেগনেন্সির কাগজগুলো দেখতে চান। কাগজগুলো দেখে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে একটি সাদা কাগজের তিন জায়গায় মৌসুমির স্বাক্ষর নিয়ে অফিসে কক্ষের বাইরে বের করে দেন।
মৌসুমির মা আঙ্গুরাকে ডেকে ধমক দিয়ে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে বের করে দেন। একই ভাবে মৌসুমির বাবা মো. মহসিনকেও ধমক দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন ইন্সপেক্টর শামীম। এরপর ইন্সপেক্টর শামীম সাক্ষীদেরও সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন এবং ভয় দেখান আদালতে সাক্ষী না দেওয়ার জন্য।
মৌসুমির মা বলেন, গত ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর নগরীর চন্দ্রিমা থানার মাজদার রহমানের ছেলে মো. মাসাদুল হাসানের সাথে তার মেয়ে মৌসুমির বিয়ে হয়। সংসার জীবনে তাদের মেহেরীমা জান্নাত তুবা নামের দুই বছর বয়সি একটি সন্তান রয়েছে। তারা ৬ মাস স্বাভাবিকভাবে দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করেন। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে শুরু হয় শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। এরপর গর্ভবতী অবস্থায় গৃহবধূ মৌসুমিকে ব্যাপক মারপিট ও পেটে লাথি মেরে আহত করা হয়। এতে গৃহবধূর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে গত ২৩ জানুয়ারী দিবাগত রাত ১০টায় নগরীর লক্ষীপুর ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরের দিন ২৪ জানুয়ারী বেলা ১১টার দিকে শ^শুর বাড়ির লোকজন গৃহবধূর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভপাত করান।
এরপর ২৫ জানুয়ারী দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্বামী মাসাদুল হাসান, শ^শুর মাজদার রহমান ও শাশুড়ী শাহানাজ পারভীন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান মৌসুমিকে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অসুস্থ মৌসুমিকে আবারো ব্যাপক মারধর করে স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন। পরে রাসিকের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর উম্মে সালমা বিষয়টি জানতে পেরে মৌসুমির মা-বাবাকে ডাকেন এবং চন্দ্রিমা থানা পুলিশে খবর দেন। খবর পেয়ে চন্দ্রিমা থানার এসআই রেজাউল ও সঙ্গীয় ফোর্স গৃহবধূকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করেন। পরের দিন ২৬ জানুয়ারী হাসপাতাল থেকে বাড়ি যান মৌসুমি। ওই দিনই তার স্বামীর দেওয়া তালাকের নোটিশ হাতে পান গৃহবধূ মৌসুমি।
এ ঘটনায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কাউন্সিলরের দারস্ত হন মৌসুমি ও তার পরিবার। কিন্তু কোন ভাবেই আপোষ-মিমাংসা করতে রাজি হয়নি স্বামী, শ^শুর ও শ^াশুড়ি। পরে মৌসুমি বাদী হয়ে জেলা রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল (১) আদালতের দারস্থ হন। নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ)/৩০ (সংশোধনী ২০০৩) তৎসহ ৩১৩ দঃ বিঃ ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেন আদালত।
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার পিবিআই ইন্সপেক্টর শামীম ও তার উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সাক্ষীর জন্য মামলার বাদি, বাদির বাবা-মা ও অন্য সাক্ষীদের সাথে তুইতুকারি করে অসম্মানজনক ভাবে কথা বলেন এবং ধমক দেন ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর শামীম গণমাধ্যমকে বলেন, ধমক দেওয়া ও সাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। বরং ঘটনা জানতে এবং তদন্তের জন্যই তাদেরকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। পরে তাদের বক্তব্য নেওয়া হয়। আর সাক্ষীদের সাক্ষ্য লিপিবব্ধ করে তাতে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
গৃবহধূ মৌসুমীর জানায় , সদ্য তালাক দেয়া তার সাবেক স্বামী দেখতে সুন্দর। তার একাধিক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। তাকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে মেয়েদের সাথে কথা বলতে শুনেছি। এমনকি বাথরুমে বসে লুকিয়ে কথা বলা অবস্থায় ধরেছি। আর এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমাকে ব্যপক শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন চালাতো। এরই ধারাবাহিকতায় আমার পেটে লাথি মারে এবং হাসপাতালে নিয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভপাত করায়। পরে ওই দিনই তালাকের নোটিশ দেয় বলে অভিযোগ গৃবহধূ মৌসুমীর।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসিক ১৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ তৌহিদুল হক সুমন বলেন, আমারা রাসিকের ৫জন কাউন্সিলর মিলে উভয় পক্ষের লোকজন নিয়ে বসেছিলাম। তাদের অনেক বোঝানো হয়েছে যাতে সংসারে ভাঙ্গন না ধরে। কিন্তু আমাদের যেটা মনে হয়েছে মৌসুমি ও মাসাদুল দম্পত্তী একে অপরের উপর সন্দেহ করে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা। আর এই অবিশ্বাস থেকেই তাদের সংসার ভেঙ্গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চেস্টা করেছি তাদের সংসার ঠিক রাখার জন্য। বুঝিয়েছি, হাত জোড় করে অনুরোধ করেছি। এই ছাড়া আমারা আর কি করতে পারি।