অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। চলতি মাসের শুরুতে আচমকা স্ট্রোক হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকে হাসপাতালে তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি ওঠানামা করছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ঐন্দ্রিলার মস্তিষ্কে জমাট বেঁধে গিয়েছে রক্ত। অভিনেত্রী ইতিমধ্যে দু’বার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছিলেন। আবার স্ট্রোক হওয়ায় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।
গত ১৯ দিন ধরে হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ঐন্দ্রিলা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অভিনেত্রীর চোখের পাতা নড়ছে না, দেহেও সাড় নেই। কোমার একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছেন তিনি।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষের চেতনার মাত্রা মাপা হয় বিশেষ এক ধরনের স্কেলের মাধ্যমে। তার নাম ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’। এই স্কেলের মাপ অনুযায়ী, যে কোনও মানুষের নম্বর হয় ৩ থেকে ১৫-র মধ্যে। মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীর চেতনার মাত্রা পরিমাপের জন্য এই স্কেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কী ভাবে নির্ধারিত হয় এই নম্বর? বস্তুত, ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ কোনও রোগীর মান নির্ধারিত হয়, চোখের নড়াচড়া, মৌখিক প্রতিক্রিয়া এবং অঙ্গ সঞ্চালনার ভিত্তিতে। এই তিন বিষয়ের উপর কোমার মাত্রা নির্ভর করে।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ এক জন সুস্থ মানুষের চেতনার মাত্রা থাকা উচিত ১৫-এর মধ্যে অন্তত ১৪। এই মান যত কম হবে, তত রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়বে। যেন জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে দড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’।
২ বছরের ঊর্ধ্বে যে কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর পরিমাপ প্রযোজ্য। ১৯৭৪ সাল থেকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর ব্যবহার হয়ে আসছে। এই বিশেষ পরিমাপ দণ্ডের উদ্ভাবক হিসাবে ব্রিটিশ চিকিৎসক ব্রায়ান জেনেট এবং গ্রাহাম টিসডেলের নাম করা হয়ে থাকে।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ চেতনা পরিমাপের প্রথম ধাপ হল চোখ। চোখের ক্ষেত্রে মোট ৪টি ধাপে মান নির্ধারিত হয়। মান ১ হওয়ার অর্থ হল, রোগী চোখ খুলছেন না। এই মান ২ হলে বুঝতে হবে, রোগী আঘাত বা ব্যথার প্রতিক্রিয়ায় চোখ খুলছেন।
চোখের চেতনার মাত্রা ৩ হলে বুঝতে হবে, রোগী শব্দ শুনেই চোখ খুলতে পারছেন। চতুর্থ পর্যায়ে রোগী চোখ ইচ্ছে অনুযায়ী চোখ খুলতে পারেন। এই পর্যায়ে থাকা রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর পরবর্তী ধাপে বিবেচিত হয় মৌখিক প্রতিক্রিয়া। এই ধাপের মোট ৫টি পর্যায়। মান ১ হওয়ার অর্থ হল, রোগী মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ করতে পারছেন না। মৌখিক প্রতিক্রিয়ার মান ২ হলে বুঝতে হবে রোগী আঘাত বা ব্যথার প্রতিক্রিয়ায় গোঙানি জাতীয় শব্দ করছেন।
মৌখিক প্রতিক্রিয়ায় মান ৩ হওয়ার অর্থ হল, ব্যথার অনুভূতি হলে রোগী চিৎকার করে উঠছেন। চতুর্থ পর্যায়ে রোগী বিরক্তিসূচক শব্দ করে থাকেন। কান্নাকাটিও করতে পারেন। পঞ্চম বা শেষ পর্যায়ে রোগীর মধ্যে স্বাভাবিক মৌখিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর পরবর্তী ধাপ হল অঙ্গ সঞ্চালন। এই ধাপের মোট ৬টি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রোগী কোনও অঙ্গ নড়াচড়া করতে পারেন না। তাঁর সারা শরীর থাকে অসাড়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ মান ২ হলে, রোগী ব্যথার প্রতিক্রিয়ায় অঙ্গ সঞ্চালনা করতে পারেন।
তৃতীয় পর্যায়ে মান হয় ৩। সে ক্ষেত্রে ব্যথা বা আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় রোগী অঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করেন। চতুর্থ পর্যায়ে ব্যথা পেলে অঙ্গ সরিয়ে নিতে পারেন রোগী।
অঙ্গ সঞ্চালনার পঞ্চম পর্যায়ে রোগীর দেহে স্পর্শ করলেই অঙ্গ সঞ্চালিত হয়। শেষ বা ষষ্ঠ পর্যায়ে রোগী নিজের ইচ্ছাতেই অঙ্গ সঞ্চালনা করতে পারেন। এই পর্যায়ে থাকার অর্থ রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
এই তিন পর্যায়ে রোগীর মান যা হয়, তার যোগফল হল ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর (জিসিএস) মান। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কোনও রোগীর
রোগীর মৌখিক প্রতিক্রিয়ার মান ৪। অর্থাৎ, তিনি বিরক্তিসূচক শব্দ করতে পারছেন। এ ছাড়া, রোগীর অঙ্গ সঞ্চালনার মান ৩। অর্থাৎ তিনি ব্যথা বা আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় অঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করছেন। তিনটি মানের যোগফল দিয়ে কোমার মাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৯।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ রোগীর কোমার মাত্রা সবচেয়ে কম হয় ৩। সে ক্ষেত্রে চোখ, মৌখিক প্রতিক্রিয়া এবং অঙ্গ সঞ্চালনায় তার মান ১।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর মান ৮ কিংবা তার কম থাকলে রোগীর পরিস্থিতি অতি সঙ্কটজনক হিসাবে বিবেচিত হয়। এই মান যদি ৯ থেকে ১২-র মধ্যে থাকে, তবে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি সঙ্কটজনক।
‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ রোগীর মান যদি ১৩ কিংবা তার বেশি হয়, তবে তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলেই ধরে নেওয়া হয়। কোমায় থাকা রোগীর ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এর মান প্রতিনিয়ত পরিমাপ করে থাকেন চিকিৎসকরা।
শিশুদের ক্ষেত্রে চেতনার পরিমাপের জন্য রয়েছে বিশেষ স্কেল। সে ক্ষেত্রে ‘পেডিয়াট্রিক গ্লাসগো কোমা স্কেল’ ব্যবহৃত হয়। ৩৬ মাসের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে এই স্কেলে কোমার মাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
২ নভেম্বর স্ট্রোক হওয়ার পর অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা কোমায় চলে গিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর কোমার মাত্রা ৩। ‘গ্লাসগো কোমা স্কেল’-এ এটিই সর্বশেষ পর্যায়। চিকিৎসকদের মতে এই পর্যায় থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
শনিবার রাতে নতুন করে বেশ কয়েক বার হৃদ্রোগে আক্রান্ত (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) হয়েছেন ঐন্দ্রিলা। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন চিকিৎসকরা। অভিনেত্রীর এই পরিস্থিতিতে তাঁর অনুরাগীরাও উৎকণ্ঠিত।