২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৪১:০৩ অপরাহ্ন


প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসারের পরিচয়ে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার
স্টাফ রিপোর্টার :
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১১-২০২২
প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসারের পরিচয়ে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসারের পরিচয়ে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার


জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী থেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসারের পরিচয়ে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ চক্রের মূলহোতা হরিদাস চন্দ্র অরফে তাওহীদ তার সহযোগীসহ গ্রেফতার।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে যে, এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র স্পর্শকাতর ব্যক্তিদের অথবা সমাজের বিভিন্ন উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বা তাদের প্রটোকল অফিসার, বা বিভিন্ন মন্ত্রীর ভুয়া এপিএস পদবী ব্যবহার করে তারা মানুষের সাথে প্রতারণা করছে এবং অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমনকি এই প্রতারক চক্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভূয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সুনাম ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করছে।

প্রতারক চক্রের প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এনএসআই ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী এলাকা হতে শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস অরফে তাওহীদ (৩৪), পিতা-শ্রী গোপীনাথ, সাং-উথলী বাজার, থানা-শিবগঞ্জ, জেলা-বগুড়া এবং মোঃ ইমরান মেহেদী হাসান (৩৮), পিতা-মোঃ সাইফুল ইসলাম, সাং-নওদার, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। জব্দ করা হয় ৪টি মোবাইল, জালিয়াতিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ডকুমেন্টস এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে এডিট করা ভুয়া ছবি।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত হরিদাস তাওহীদ প্রতারক চক্রের মূলহোতা। সে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন সময়ে নিয়ম বর্হিভ‚তভাবে অবৈধ উপায়ে পার্শ্ব র্তী দেশে গমন করে তার এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করে। তার আত্মীয়ের মাধ্যমে সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের নিকট হতে কৌশলে একটি এতিম সার্টিফিকেট গ্রহণ করে এবং সেখানকার স্থানীয় একটি স্কুল হতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এবং ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে বাংলাদেশে এসে রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি ক্রয় পূর্বক মেরামত করে বিক্রির কাজ শুরু করে। এসময় উত্তরার একটি হাসপাতালের এসি মেরামত বা এসি প্রদানের বিষয়ে তার সাথে চুক্তি হয়। অতপর ২০১৮ সালে একজন সবজী বিক্রেতার সাথে সাবলেট বাসা ভাড়া নেয়। বাসা ভাড়া থাকা অবস্থায় তার মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য ২০১৯ সালে সে ধর্মান্তরিত হয়। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সে তার নাম শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস পরিবর্তন করে তাওহীদ ইসলাম ধারণ করে।  

 গ্রেফতারকৃত হরিদাস অরফে তাওহীদ আরও জানায় যে, তার শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় সে কিছু জমি ক্রয় করে। তার শ্বশুরের মাধ্যমে এলাকার লোকের সাথে নিজেকে একজন বিত্তশালী লোক হিসেবে পরিচিত হয়। পাশাপাশি সে এটাও প্রচার করতে থাকে যে, সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার। তখন সে দামী গাড়ি এবং দামী পোশাক পরে মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হত এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের প্রস্তাব দিত। এলাকার বিত্তশালী লোক এসব প্রজেক্টে বিনিয়োগ করলে তাদের লভ্যাংশ প্রদান করা হবে। এছাড়াও প্রজেক্ট শুরু হলে, প্রজেক্ট সমাপ্ত করার জন্য সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর হতে অর্থ এবং উন্নয়নমূলক কাজের সম্পন্ন করতে তাদেরকে আশ্বস্থ করত। এছাড়াও এসব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে এলাকার উন্নতি হবে মর্মে প্রলুদ্ধ করত। তার প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই চাকুরী, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবীর করার জন্য তার সহায়তা চায়। উক্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সে চাকুরী প্রত্যাশী, পছন্দমত জায়গায় বদলি প্রত্যাশী সরকারী চাকুরীজীবি, বিভিন্ন ক্রয় বিক্রয় ও উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিকট থেকে টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকে। এ সময় গ্রেফতারকৃত ইমরান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার বিভিন্ন সহযোগীসহ অন্যান্য ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে হরিদাসের নিকট নিয়ে আসত। এসময় হরিদাস@ তাওহীদ এসকল ব্যক্তিদেরকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে চাকুরী, পদোন্নতি এবং বদলীর বিষয়ে আশ^স্থ করে তাদের নিকট হতে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করত। গ্রেফতারকৃত হরিদাস অরফে তাওহীদ অত্যন্ত বচনপটু। একবার তার সাথে কেউ পরিচিত হলে তার প্রতারণার খপ্পর হতে বের হতে পারেনা।

গ্রেফতারকৃত তাওহীদ আরও জানায় যে, সে প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় ০১ বিঘা জমি ক্রয় করে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করে। উক্ত কাজ শুরু হলে তার প্রলোভনে আরও অনেকেই টাকা লেনদেনের রসিদ ছাড়া তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রদান করে। ২০২০ সাল প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। রিসোর্টে প্রবেশ মূল্য ৫০/- টাকা, সুইমিংপুলে গোসল ১০০/- টাকা এবং রিসোর্টের ভিতরে ঘোরাঘুরির জন্য ৫০/- টাকা করে টিকেট ক্রয় করতে হত। দলে দলে পর্যটক তার রিসোর্টে ভিড় করতে থাকে। অনেকে বিবাহ, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তার রিসোর্ট ভাড়া নিতে থাকে। তখন সে বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তিদের তার রিসোর্টে আমন্ত্রণ জানায় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে এডিট করা ছবি প্রদর্শন করে তার প্রজেক্টসহ অন্যান্য প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে। এর মাধ্যমে সে অনেকের নিকট হতে অর্থ আদায় করত।  

গ্রেফতারকৃত হরিদাস চন্দ্র অরফে মোঃ তাওহীদ ইসলাম এর প্রকৃত নাম শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস, পিতা-শ্রী গোপিনাথ তরনীদাস, জেলা-বগুড়া। সে উক্ত প্রতারক চক্রের মূলহোতা। চক্রে তার ৫-৬ জন সহযোগী রয়েছে। তার মোবাইলে বিভিন্ন নম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এবং নিকটাত্মীয়ের বিভিন্ন সদস্যদের নামে সেইভ করা আছে। সে প্রতারণা করার সময় উক্ত সেইভ নম্বরগুলোতে কল দিয়ে ভিকটিমকে প্রতারিত করে মোবাইল স্ক্রীনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নাম প্রদর্শন করে। সহজ সরল ভিকটিমগণ উক্ত নম্বরকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের নম্বর মনে করে প্রতারিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তার কোন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর সাথে পরিচয় নেই। তার কোন দলীয় পরিচয় নেই। প্রতারণা করে অর্থ উপার্জনই তার মূল লক্ষ এবং পেশা। 

গ্রেফতারকৃত তাওহীদ অরফে শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার একটি ছবি এডিট করে তার ওয়ালপেপারে সংযুক্ত করে রাখে। তখন থেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙ্গিয়ে কিভাবে অর্থ উপার্জন করা যায় তার ফন্দিফিকির করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে সে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৯ সালে ধর্মান্তারিত হওয়ার পর শ্বশুর বাড়ির পরিচয় ব্যবহার করে ময়মনসিংহ এলাকায় তার প্রতারণার ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়। এপর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে সে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট রিসোর্টসহ ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় নামে বেনামে অনেক জমি ক্রয় করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও একাধিক ব্যাংকে তার নামে বেনামে বিভিন্ন একাউন্ট রয়েছে। গোয়েন্দা সূক্রে উক্ত একাউন্ট গুলোতে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের প্রমান পাওয়া গেছে। সে কখনো নিজেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা বা তাঁর পরিবারের প্রটোকল অফিসার, বৈমানিক কর্মকর্তাসহ ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাবিধ প্রতারণা করে আসছিল। সে ফুলবাড়িয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পদে চাকুরী দেওয়ার নাম করে শতাধিক লোকের নিকট হতে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তার কাজে বাধা দেওয়ায় সে একজন স্থানীয় নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি প্রদান করে। সে বিভিন্ন সরকারী কার্যালয়ে টেন্ডারের বিষয়ে তদবীর করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের পরিচয় দিয়ে ফোনালাপ করে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের নিকট হতে অর্থ হাতিয়ে নেয়। যদিও সে কাউকে কাজ পাইয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। সে স্বর্ণ চোরাচালান ও স্বর্ণের বারের অবৈধ বানিজ্যের সাথেও জড়িত ছিল বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর ক্যাশিয়ার। তার নামে নানাবিধ অপকর্ম যেমন; প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকুরী প্রদান, অনলাইনে নিবন্ধন আবেদন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নবায়নসহ অর্থ জালিয়াতির বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিল থাকায়  শাস্তিস্বরূপ ২০২২ সালের প্রথম দিকে বিভাগীয় শহর হতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। এছাড়াও সে অসুস্থতার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আগস্ট ২০২২ হতে কর্মস্থলে গড় হাজির রয়েছে।

পরবর্তীতে সে ইমরান হরিদাস অরফে তাওহীদের মাধ্যমে নিজের বদলী বাতিল করার চেষ্টা করে। ইমরান যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যম ছাড়া বিধি বর্হিভ‚তভাবে তার বদলী বাতিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে। উক্ত আবেদনের একটি কপি সে গ্রেফতারকৃত তাওহীদকে দেখায়। তারপর তারা দুজন মিলে উক্ত কপির উপরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যের নাম লিখে ভুয়া সীল দিয়ে একটি ভুয়া ডিও লেটার তৈরী করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে এ্যাপসের মাধ্যমে প্রেরণ করে দ্রুত বদলীর আদেশ বাতিল করে পূর্বের পদে বহালের জন্য সুপারিশ করে। উক্ত ডিও লেটারটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এনএসআই এর নিকট অভিযোগ করেন। উক্ত অভিযোগের ছায়াতদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। ধৃত আসামীরাও জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কৃতকর্মের বিষয়টি স্বীকার করে।