মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শরণার্থী হিসাবে আশ্রিত এরা শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। জড়াচ্ছে শিশু চুরিসহ নানা সামাজিক অপরাধে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কারণে অতিষ্ঠ স্থানীয় জনগণ। তারা স্থানীয় মানুষের সাথে এমনভাবে মিশে রয়েছে যে, বাঙালি নাকি রোহিঙ্গা তা বুঝা মুশকিল। এ সংখ্যা হবে এক লাখের ও বেশি।
রোহিঙ্গারা বাংলাদশের নাগরিকত্বও নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই নাগরিকত্বের সূত্র ধরে পাসপোর্ট তৈরি করে অন্য দেশেও চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের নাগরিকরা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেকটাই শিথিল। এ সুযোগে এক শ্রেণির দালাল গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের নিয়ে বৈধ-অবৈধ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। ইদানীং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা আটকের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কাজের খোঁজ ছাড়াও শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পেতে ও ধনী হওয়ার আশায় স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগিতায় বিদেশ পাড়ি দেয়ার ইচ্ছায় অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে আটক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
জানা যায়, যতই দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধ কার্যক্রম বাড়ছে। রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি ছাড়াও মাদকের ব্যবসা, অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থার বেসরকারি তথ্যমতে পাঁচ বছরে ক্যাম্পে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরণের অপরাধে মোট ২ হাজার ৪৩৮ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে মোট আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ২২৬ জন। ৫ বছরে অস্ত্র আইনে ১৮৫টি, মাদক আইনে ১ হাজার ৬৩৬টি ও ধর্ষণের মতো অপরাধে ৮৮টি মামলা হয়েছে।
এছাড়া অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টা মামলা হয়েছে ৩৯টি। এ ৫ বছরের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ১১০টির বেশি। যদিও ৫ বছরের হত্যা মামলার সংখ্যা ১০০টি। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিশু জন্মের হার। গত পাঁচ বছরে ক্যাম্পে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এছাড়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় শ্রমবাজারে নিজেদের দখল পাকাপোক্ত করেছে। স্থানীয়রা দৈনিক ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা মজুরিতে কাজ করলেও সেখানে রোহিঙ্গারা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় কাজ করছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামের পটিয়ার হাইদগাঁও, কেলিশহর, কচুয়াই, কালিয়াইশ ও কুসুমপুরা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা ভাড়া বাসায় থাকছেন। এমনকি এদের মধ্যে কেউ কেউ পটিয়ার নাগরিক পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রাম শহরেও কাজ করছেন।
চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের উত্তর এলাহবাদ, হাশিমপুরের পাহাড়ি এলাকা, ধোপাছড়ি পাহাড়ি অঞ্চল, কাঞ্চনাবাদ, সাতবাড়িয়া এবং দোহাজারির বেশ কয়েকটি বার্মা কলোনিতে ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। শুধুমাত্র বার্মা কলোনিতে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বর্তমানে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে কয়েক দশক পূর্বে আসা অনেক রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকও হয়েছেন।
সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা, কেঁওচিয়া, আমিলাইশ, কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া, পুরানগড়, ঢেমশাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আনুমানিক ১০ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বসবাস করছেন।
শুধুমাত্র ছদাহা ইউনিয়নের হাসমত আলী সিকদার দোকানের পাশে একটি কলোনিতে ৫০০ জন, পূর্ব ছদাহার হাবিবের মাছের ঘেরে ১০০ জন, ছদাহা কেওচিয়া স্কুল সড়কে কয়েকটি কলোনিতে ২৫০ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন।
এ কলোনির মালিক আব্দুল কাইয়ুমও মিয়ানমারের নাগরিক। বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যান। তিনি এখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও উপজেলার ছদাহা ও কেওচিয়া সীমান্ত এলাকা হরিণতোয়াতে কয়েকশ রোহিঙ্গা রয়েছেন।
লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা, চুনতী, বড় হাতিয়া, পদুয়া ও লোহাগাড়া সদরের বিভিন্ন ভাড়া বাসায় আনুমানিক ২০ হাজারের মত রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। এছাড়া উপজেলার বন বিভাগের পাহাড় দখল করেও কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যায়।
এছাড়া বোয়ালখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম মহানগর ও উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই এলাকায় বিভিন্ন ইটভাটা এবং কলকারখানার স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে রোহিঙ্গারা কাজ করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এসব রোহিঙ্গা দিনের বেলায় লোক দেখানো অল্প বেতনে কাজ করলে ও রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন অপর্কম চালায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আবার এলাকায় কোনো কোনো রোহিঙ্গা স্থানীয় গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করে শিকড়ও পোক্ত করে ফেলেছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা ক্যাম্প-১০ এর নজু মিয়ার ছেলে শফি (২১) নামের এক যুবক বলেন, কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারগুলোতে প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করেন। শুধু তিনি নন, ক্যাম্প থেকে হাজার হাজার শরণার্থী পালিয়ে আসছে, এমনকি অনেকে পরিবারসহ বেরিয়ে পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসতে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না তাদের। ইচ্ছেমতো দেশের যে কোনো অঞ্চলে যাওয়া যায়। তাদের কয়েকজনের সাথে জন্মসনদও আছে। আবার কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলার লোকজনের জন্মনিবন্ধনও তারা ব্যবহার করেন। কেউ ঠিকানা জানতে চাইলে পরিচিত কোনো একটা জায়গার নাম বলে দেন। বিশেষ করে ভাষাগত কিছুটা মিল থাকায় টেকনাফ ও চকরিয়া-পেকুয়া এলাকার বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন। ওখানকার স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নাম মুখস্ত রাখেন। টাকার বিনিময়ে অনেকে জন্মসনদও নিয়ে রাখেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, রোহিঙ্গারা মাদকসহ বেশকিছু অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তাদের এসব অপরাধ ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকে একটি সুবিধাভোগী মহল। এ কারণে দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরসহ অন্য জেলায় বা অন্য কোনো দেশে স্থানান্তর করার দাবি তাদের।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরাসরি মাদক এনে আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ আজ থেকে ১০ বছর আগে ইয়াবা সম্পর্কে তেমন জানতেন না, যা রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদশে বিস্তার লাভ করেছে। আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, কোথায় এবং কোন এলাকায় রোহিঙ্গা আছে আমাকে জানান। আমরা কোনো রোহিঙ্গাকে প্রশ্রয় দেব না। এছাড়া রোহিঙ্গারা যদি কোনো জনপ্রতিনিধির আশ্রয় বা প্রশ্রয়ে অবস্থান করে তবে সেসব জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।