২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৩:২৭:৩৮ পূর্বাহ্ন


জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৭-২০২২
জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা ফাইল ফটো


ডলারসংকটের কারণে ব্যাংকগুলো জ্বালানি তেলের এলসি (ঋণপত্র) খুলছে না। আর এলসি খুললেও সময়মতো ডলারের দাম পরিশোধে দেরি হচ্ছে। ফলে তেল সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থাগুলোর পাওনা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দ্রুত পাওনা পরিশোধে বিপিসিকে চাপ দিচ্ছে তেল সরবরাহকারী কম্পানিগুলো।

বিজ্ঞাপন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে সমাধান চেয়েছে বিপিসি।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, গত জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত চার দফা চিঠির মাধ্যমে অর্থ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ঋণপত্র খোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করে বিপিসি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি বিভাগে বিপিসি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে বিপিসি আশঙ্কা করছে।

জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘বাজারে ডলার বিনিময় হারের নানা পার্থক্যের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। তাই যাঁরা আমাদের তেল সরবরাহ করেন, তাঁদের নির্ধারিত সময়ে এলসি পেমেন্ট দিতে পারছি না। কখনো আংশিক বা ভেঙে ভেঙে দিতে হচ্ছে। কখনো বিলম্বিত হচ্ছে। এ অবস্থায় তেল সরবরাহকারী সংস্থাগুলো পাওনা পরিশোধে আমাদের চাপ দিচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে আস্থার তেল সরবরাহকারীদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হবে। ’ বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ এলসি খুলে পেমেন্টকারী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। আশা করি দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি উল্লেখ করে, এপ্রিল থেকেই ঋণপত্র খোলা ও তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। মাঝে কিছু ডলার ছাড়া হলেও এখন আবার নতুন করে ব্যাংকে সমস্যা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক নতুন করে ঋণপত্র খুলতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আবার ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর দর পরিশোধে দেরি করছে কেউ কেউ।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১১ শতাংশ। জ্বালানি পণ্যের জন্য আগে ৩৯৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হলেও তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৩৭ কোটি ডলারে। একই সময়ে আগে পরিশোধ করা হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার এবং সর্বশেষ পাঁচ মাসে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭৭ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দু-একটি ব্যাংক সাময়িক সময়ের জন্য এলসি খোলায় বিলম্ব করে থাকতে পারে। ধারাবাহিকভাবে করছে না। বিপিসি চিঠি পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি তদারকি করছে। ’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি বিপিসির নতুন সমস্যা না। এর আগেও বিপিসি বিভিন্ন সময়ে পাওনা পরিশোধে ডলারসংকটে পড়েছে। ডলারসংকটে যদি বিসিপি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তাহলে সামনে বড় ধরনের সংকট বা পরিস্থিতিতে পড়বে দেশ। তাই এটিকে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে। ’

জ্বালানি সাশ্রয়ে অফিস-আদালতের কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা আগানোর পরামর্শ দিয়েছে ম. তামিম বলেন,  ‘যেহেতু এখন গ্রীষ্মকাল চলছে তাই কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা আগানো যেতে পারে। ’

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি হয়। তার মধ্যে বছরে ৪০ লাখ টন শুধু ডিজেলই আমদানি হয়। দেশে পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশের বেশি যানবাহন জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতারও ৩৪ শতাংশ নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর।

বাংলাদেশ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। তেল সরবরাহকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সৌদি আরবের সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কম্পানি (সৌদি আরামকো), আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক), কুয়েতের কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (কেপিসি), মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল), আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কম্পানি (ইনক), চীনের পেট্রোচায়না (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড ও ইউনিপেক (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকু (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড, ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল)। এর বাইরে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেও জ্বালানি তেল কেনে বিপিসি।

এদিকে এলসি খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেওয়া যাবে না। এতে ব্যাহত হবে তেল আমদানি। আর আমদানি কমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘটবে ব্যাঘাত। সংকটে পড়বে পরিবহন খাত। জটিলতা তৈরি হবে কৃষকের সেচকাজেও।

জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) দাম বেশ কয়েক মাস পর প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের নিচে নেমেছে। গত শনিবার সকালে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৯৮ ডলার। একই দিন সন্ধ্যায় আমেরিকান অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি কমে দাঁড়ায় ৯৭.৫০ ডলারে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। সে সময় প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ১৩৯ ডলার ছড়িয়ে যায়। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি ছিল কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য তার আগেই গত বছর বিশ্বজুড়ে বিধি-নিষেধ উঠে যাওয়ার পর হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেলে জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালের নভেম্বরে যখন দেশে তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারের মতো। এর পর ইউক্রেন যুদ্ধের  প্রভাবে তেলের দাম লাগাতার বাড়তে শুরু করে।