আল্লাহর রহমত ও নেয়ামতে মোড়ানো মুমিনের জীবন। রহমত ও নেয়ামাত পাওয়ার সেরা দিন জুমা। জুমার দিনে ঈমানদারের জীবনে এসব নেয়ামত পাপ্তির তুলনা অনেক বেশি, অসংখ্য। এ কারণে মহান আল্লাহ বান্দাকে লক্ষ্য করে সুরা আর রাহমানে বার বার জিজ্ঞাসার সূরে বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন অবদান (রহমত-নেয়ামতকে) অস্বীকার করবে?
আর আল্লাহর রহমত ও নেয়ামতে ভরপুরের দিন জুমা। দিনটির প্রতিটি পরতে পরতে; ক্ষণে ক্ষণে সাজিয়ে রেখেছেন রহমত-বরকত-মাগফেরাত-নাজাত। জুমার দিনের এসব নেয়ামত ও রহমতগুলো কী?
মুসলিম উম্মাহ দুনিয়াতে দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসবে ইসলাম। আবার বিশ্বনবির মহান উম্মাত। আবার জুমার দিনটি উম্মতে মুসলিমার জন্য সেরা প্রাপ্তি ও ইবদতের দিন। যদি আল্লাহ উম্মতে মুসলিমাকে দিনটি দিয়েছেন সবার পরে কিন্তু কেয়ামতের দিন সার্বিক মর্যাদার দিক থেকে উম্মতে মুসলিম হবে সবার অগ্রবর্তী। এ সবই মুমিন মুসলমানের জন্য নেয়ামত ও রহমত। জুমার দিনটি শুধু এই উম্মতের জন্যই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হাদিসে পাকে এসেছে-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকে জুমার দিন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা অজ্ঞ রেখেছেন। ইয়াহুদিদের ফজিলতপূর্ণ দিবস ছিল শনিবার। খ্রিস্টানদের ছিল রোববার। এরপর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠালেন এবং জুমার দিনের ফজিলত দান করলেন। ধারাবাহিকভাবে শনি ও রোববারকে শুক্রবারের পরে রাখলেন। দুনিয়ার এই ধারাবাহিকতায় কেয়ামতের দিনও ইয়াহুদি খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের পরে থাকবে। আমরা উম্মত হিসেবে (মুসলিম উম্মাহ) সবার শেষে এলেও কেয়ামতের দিন সব সৃষ্টির আগে থাকব (উম্মতে মুহাম্মাদি)। (মুসলিম)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'দুনিয়াতে যত দিন সূর্য উঠে; তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হলো (জুমার দিন) শুক্রবার। এ দিনে আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে। এ দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছিল। সর্বশেষ কেয়ামত সংঘটিত হবে শুক্রবারের এই পবিত্র ও মর্যাদার দিনে।' (মুসলিম)
৩. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমার দিন শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক সম্মানিত।' (ইবনে মাজাহ)
৪. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিন গুনাহ মাফের দিন। যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরে এবং তার কাছে থাকলে সে সুগন্ধি ব্যবহার করে। তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের কাউকে না টপকিয়ে (গায়ের ওপর দিয়ে) সামনের দিকে না যায়। নির্ধারিত নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে (নামাজের) সালাম (ফেরানো) পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পরবর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যায়।' (আবু দাউদ)
৫. জুমার দিন প্রতি কদমে এক বছরের নেকি লাভ হয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি জুমার দিনে উত্তমরূপে গোসল করে আগে আগে মসজিদে যায় এবং বাহনে না চড়ে পায়ে হেঁটে মসজিদে যায়। ইমামের কাছাকাছি বসে মনোযোগ দিয়ে ইমামের আলোচনা শোনে, অনর্থক কাজ করা থেকে বিরত থাকে। তবে তার প্রতি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা এক বছরের রোজা ও নামাজের সাওয়াব দান করেন (তিরমিজি)
৬. জুমার দিন মুমিন মুসলমানদের ঈদের বিশেষ দিন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম বলেছেন, 'এই দিন অর্থাৎ জুমার দিনকে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য ঈদের বিশেষ দিন বানিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ)
৭. জুমার দিন কবরের আজাব থেকে মুক্তির দিন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'কোনো মুসলমান শুক্রবারে রাতে কিংবা দিনে ইন্তেকাল করলে আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দান করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।' (তিরমিজি)
৮. জুমার দিনটি মুসলমানদের ঈদের দিন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এই দিন অর্থাৎ জুমার দিন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য (বিশেষ মর্যাদা হিসেবে) ঈদের দিন বানিয়েছেন।' (ইবনে মাজাহ)
৯. জুমার দিনের ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করাও ফজিলতপূর্ণ। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো শুক্রবারের ফজরের নামাজ। যা জামাতের সাথে আদায় করা হয়। (সিলসিলাতুস সহিহা)
এ ছাড়াও জুমার দিনের যেসব কাজ নেয়ামত-রহমত-বরকত-মাগফেরাত ও ফজিলতপূর্ণ কল্যাণে পরিপূর্ণ যেসব আমল ও কাজ তাহলো-
> গোসল করা।
> উত্তম পোশাক পরা।
> সুগন্ধি ব্যবহার করা।
> আগে আগে মসজিদে যাওয়া।
জুমার দিন সম্পর্কে কোরআনের ঘোষণা
আল্লাহ তাআলা বলেছেন
১. یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! যখন জুমার দিনে নামাজের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। আর বেচা-কেনা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে।' (সুরা জুমআ : আয়াত ৯)
২. فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰهِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
‘এরপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।' (সুরা জুমআ : ১০)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
১. কোরবানির ফজিলত লাভ
জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসে, সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। এরপর যে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো; যে একটি গাভী কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর মতো। তারপর ইমাম যখন খুতবার দেওয়ার জন্য বের হন; তখন ফেরেশতাগণ তাদের লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগসহকারে খুতবা শুনতে থাকেন।' (বুখারি)
২. প্রশান্তি পেতে সুরা কাহফ তেলাওয়াতের আমল
> আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে, তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর উজ্জ্বল করা হবে। (আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইল)
> হজরত সাহাল ইবনে মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করবে; তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটি নূর হয়ে যায়। আর যে পূর্ণ সুরা তেলাওয়াত করে তার জন্য জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত নূর হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ)
> হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, যে সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করবে; সে দাজ্জালের ফিৎনা হতে নিরাপদ থাকবে। অন্য হাদিসে ভিন্ন রেওয়ায়েতে শেষ ১০ আয়াতের ব্যাপারে উল্লিখিত ফজিলতের বর্ণনা রয়েছে। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদ)
সুতরাং প্রথম বা শেষ ১০ আয়াত অথবা উভয় দিক দিয়ে মোট ২০ আয়াত যে মুখস্ত করবে সেও হাদিসের ঘোষিত ফজিলত লাভের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
> হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য এক জুমা থেকে অপর (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত নূর হবে।
> হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, সে আটদিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফেৎনা থেকেও মুক্ত থাকবে।
> অন্য রেওয়ায়েতে আছে এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে উল্লিখিত গুনাহ মাফ হওয়ার দ্বারা সগিরা গুনাহ উদ্দেশ্য। কারণ ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হচ্ছে যে, কবিরা গুনাহ তওবা করা ছাড়া ক্ষমা হয় না।
৩. বেশি বেশি দরূদ শরিফ পড়া
জুমার দিনব্যাপী আরেকটি আমল হচ্ছে নবিজীর ওপর বেশি বেশি দরূদ পড়া। এই মর্মে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'তোমরা এই দিনে আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরূদ পড়া। কেননা তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়ে থাকে।' (আবু দাউদ)
৪. কথা না বলে ইবাদত করা
জুমার দিন আগে আগে পায়ে হেঁটে মসজিদে এসে জিকির, তেলাওয়াত ও ইবাদত-বন্দেগিসহ তাওবাহ-ইসতেগফার করা। ভিন্ন অপ্রয়োজনীয় অন্য কোনো কথা না বলা। নবিজী সাল্লাল্লাহু আল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'জুমার নামাজের খুতবার সময় তুমি যদি তোমার সাথিকে চুপ থাকতে বলো, তবে এটাও তোমার অনর্থক কাজ হবে।' (বুখারি)
৫. জুমার দিনের দোয়ার বিশেষ মুহূর্ত ও গুরুত্ব
জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ একটি আমল হচ্ছে দোয়ার প্রতি মনোনিবেশ করা। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'জুমার পুরো দিনের মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত এমন আছে যে, তখন কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে যে দোয়া করবে আল্লাহ তা কবুল করেন।' (আবু দাউদ)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, নেয়ামতে ভরপুর জুমার দিনটি হকআদায় করে পালন করা। ইবাদত-বন্দেগিতে দিনটি অতিবাহিত করা। কোরআন-সুুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জুমার দিন আমল-ইবাদতে পালন করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিনের রহমত ও নেয়ামতে পরিপূর্ণ আমলি জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর আমলে জীবন সাজানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
রাজশাহীর সময় / এম জি