রাজশাহীর তানোর প্রচন্ড খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট ও ভুমিকম্প প্রবণ এলাকা। কিন্ত এরই মাঝে উপজেলা সেচ কমিটি ফের নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৩০টি ব্যক্তিগত অগভীর নলকুপ স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে উপজেলায় খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঝড় ও ভুমিকম্পের আশংকা আরো বেড়েছে। তানোর উপজেলা অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভা, পাঁচন্দর ও কলমা ইউপির অনেক এলাকায় বছরের ৯ মাসই বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেয়।
এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে তানোরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ ভাগের বেশি ইউনিয়নে (ইউপি) ভূগর্ভস্থ পানিশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার ও সেচের পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্ত্ত এই পরিস্থিতির মধ্যেই নীতিমালা লঙ্ঘন করে ব্যক্তি মালিকানায় আরও ৩০টি অগভীর নলকূপের অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এখবর ছড়িয়ে পড়লে অফিস পাড়ায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, জনমনেও ছড়িয়ে পড়েছে চরম অসন্তোষ। কি বিবেচনায় একই সঙ্গে এতোগুলো অগভীর নলকুপের অনুমোদন দেয়া হলো সেই বিষয়টি অবশ্যই অধিকতর তদন্তের দাবি রাখে। স্থানীয়রা এবিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদুক) তদন্ত দাবি করেছেন।
জানা গেছে, ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক মাঠ সমীক্ষায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকটের উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব ছাড়াও নির্বিচার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই এমন সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধে নতুন করে গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপনের সুযোগ না দেওয়ার জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের উচ্চ মহলে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, জরিপে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এলেও সম্প্রতি রাজশাহীর তানোর উপজেলা সেচ কমিটি ব্যক্তিগত মালিকানায় ফের নতুন ৩০টি অগভীর নলকূপ স্থাপনের লাইসেন্সের সুপারিশ করেছেন।এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্ সৃষ্টি হয়েছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, সুপারিশকৃত এসব অগভীর নলকূপ ব্যক্তিগত মালিকানায় বাণিজ্যিকভাবে সেচ বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হবে। যদিও কাগজপত্রে এসব অগভীর নলকূপ ক্ষুদ্র ও কৃষি ভিত্তিক শিল্পের কথা বলে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। গবেষণা সমীক্ষায় যদিও বলা হয়েছে তানোর উপজেলা এলাকার ভূগর্ভের পানিস্তর বছর বছর নিচে নামছে। আবারো নতুন কর গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে ভূগর্ভের পানিস্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির প্রবল সংকট দেখা দিবে। এতে খরা, বন্যা ও ভুমিকম্পের আশঙ্কাও বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান সেচ আইনে বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপন পুরোপুরি অবৈধ ও বেআইনি। এরপরও বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে সেচ কমিটি এমন বেআইনি কাজের অনুমতি দিয়েছেন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
প্রসঙ্গত, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদাধিকার বলে উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের(বিএমডিএ) সহকারী প্রকৌশলী সদস্য সচিব। সেচ কমিটির সভাপতি ছাড়াও সেচ কমিটির কয়েকজনের বিরুদ্ধে এসব অবৈধ অনুমোদনের জন্য মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের গুঞ্জন বইছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তানোর উপজেলাজুড়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ৫২৯টি সরকারি গভীর নলকূপ বিদ্যমান রয়েছে। গত এক দশকে এর বাইরেও তিন হাজারের অধিক গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। বিদ্যমান সেচ আইন অনুযায়ী বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপনের কোনো সুযোগ না থাকলেও উপজেলা সেচ কমিটিকে ম্যানেজ করেই এসব বেআইনি কর্মকাণ্ড চলে আসছে। বিএমডিএ থেকে জোর আপত্তি তোলা হলেও তানোরে থেমে নেই ব্যক্তি মালিকানার গভীর নলকূপ স্থাপন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এবারে যে ৩০টি অগভীর নলকূপের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে তার প্রতিটির জন্য সেচ কমিটিকে প্রায় ৫ লাখ টাকা করে আর্থিক সুবিধা দিতে হয়েছে। এসব টাকার মধ্যে প্রতিটির জন্য ৩ লাখ টাকা করে নিয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাবশালী চক্র বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তারা স্থানীয় এমপির নামে এই টাকা নিয়েছেন এবং
বাকি দুই লাখ টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সেচ কমিটির অন্য সদস্যরা ভাগ করে নিয়েছেন বলেও গুঞ্জন বইছে।
এদিকে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সাংসদ আলহাজ্ব এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী নতুন করে গভীর বা অগভীর নলকূপের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্ত্ত তার পরেও অজ্ঞাত কারণে সেচ কমিটির সভাপতির ক্ষমতাবলে ইউএনও বদলির আগে একই সঙ্গে এতোগুলো অবৈধ অগভীর নলকুপ স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন। এবিষয়ে জানতে চাইলে তানোরের বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) বিল্লাল হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, তানোরে পোল্ট্রি খামার ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের নামে অবৈধভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার সেচ বাণিজ্য করছেন একশ্রেণির নলকুপ মালিক।অথচ ভয়ংকর পরিবেশগত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হলেও ব্যক্তি মালিকানায় গভীর-অভীর নলকূপ দেওয়া হচ্ছে। এবারো অনুমোদন পাওয়া ৩০টি গভীর নলকূপ বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের নাম করে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দিতেই ক্ষুদ্র শিল্পের নাম করে গভীর-অগভীর নলকূপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে যা বাস্তবে সঠিক নয়। শতভাগ ব্যক্তি মালিকানার এসব গভীর-অগভীর নলকূপ থেকে সেচ বিক্রি করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। সাশ্রয়ী হারে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেচ বিক্রি করে মালিকরা কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দিচ্ছেন। এবিষয়ে বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, মালিকরা কাগজপত্রে ক্ষুদ্র ও কৃষি শিল্প দেখানোর কারণ এসব খাতের বিদ্যুৎ বিল ইউনিট প্রতি ৪ টাকা ২৫ পয়সা। অন্যদিকে বাসা বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৫০ পয়সা। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও নেসকো এসব সংযোগ দিয়ে আসছে নির্বিচারে। পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য জানেন কিনা তা আমরা বলতে পারছি না, তবে ক্ষুদ্র ও কৃষি শিল্পর নামে নেয়া অগভীর নলকুপ থেকে সেচ বাণিজ্যের অভিযোগ পেলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এলাকা বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বিগত ১৯৮৫ সাল থেকে বরেন্দ্র এলাকাজুড়ে গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের পানি তুলছে বিএমডিএ। ওয়ারপোর মাঠ সমীক্ষায় বরেন্দ্র অঞ্চলের দুটি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে রাজশাহীর তানোর ও অন্যটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এলাকা।
রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী এলাকা দুটি অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভা, বাধাইড়,পাঁচন্দর ও কলমা ইউপির অনেক এলাকায় বছরের ৯ মাসই পানির সংকট বিরাজ করছে। গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করা হলেও উপজেলা সেচ কমিটি আরও নতুন ৩০টি গভীর-অগভীর নলকূপের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়ায় বিদ্যমান সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ বলেন, বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে বিশেষ করে তানোরের মতো সংকটাপন্ন এলাকায় নতুন করে গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। উপজেলা সেচ কমিটি কেন কিভাবে এসব অনুমোদন দিয়েছেন বিএমডিএ তা খতিয়ে দেখবে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, রাজশাহীর প্রচন্ড খরাপ্রবণ তানোর উপজেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ সেচ প্রকল্প কৃষিক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্ত্ত উপজেলা সেচ কমিটির নির্বিচারে গভীর-অগভীর নলকুপ স্থাপনের অনুমতি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (তানোর জোন) একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে বিএমডিএ’র সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে।