২৬ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৪:৩১:১০ অপরাহ্ন


নতুন হবে পুরান ঢাকা
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২৩
নতুন হবে পুরান ঢাকা সংগৃহিত ছবি


বুড়িগঙ্গা তীরের জনাকীর্ণ জনপদ পুরান ঢাকাকে নতুন রূপ দিতে চায় সরকার। এলাকাটি বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বেশ আগেই। যানজট, জলাবদ্ধতা, সরু সড়ক, জনঘনত্ব, অগ্নিকান্ড, আলো-বাতাসের স্বল্পতা, পানি ও গ্যাসের সংকট, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনজনিত সমস্যায় জর্জরিত এ জনপদ। এসবের সমাধান করে বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে ‘নগর পুনঃউন্নয়ন’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

পুরান ঢাকার বাসযোগ্যতা না থাকায় ওই এলাকা ছেড়ে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, মিরপুর, বসুন্ধরা প্রভৃতি এলাকায় চলে যাচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা। এতে পুরান ঢাকার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। ১৬১০ সালে রাজধানীর স্বীকৃতি পাওয়া ৪১৩ বছরের পুরাতন এ শহরের মানববসতির ইতিহাস হাজার বছরের। এর জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর উন্নয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায়ে সংস্থাটি পুরান ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকার সাতটি জায়গা চিহ্নিত করে সমীক্ষাকাজ শুরু হয়েছে। এলাকাগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজার, সোয়ারীঘাট, লালবাগ, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল ও হাজারীবাগ। পাইলট প্রকল্পের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে হাজারীবাগ ও লালবাগ এলাকাকে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ দুই এলাকায় নগর পুনঃউন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হবে। ‘আদি ঢাকা’র পুরো অংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাভুক্ত। রাজউকের তথ্যমতে, ডিএসসিসির ২৪, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আদি ঢাকার অংশ। এসব এলাকার আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। পরবর্তী সময়ের নগরায়ণে পুরান ঢাকাসংলগ্ন ডিএসসিসির কিছু এলাকাও ঘিঞ্জি জনপদে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকা নতুন করে গড়ে তুলবে রাজউক। কামরাঙ্গীরচর এসব এলাকার প্রথম পর্বের তালিকায় রয়েছে।

রাজউক জানায়, বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ ‘আরবান রিজেনারেশন বা নগর পুনঃউন্নয়ন’ পদ্ধতির মাধ্যমে পুরাতন জরাজীর্ণ শহরকে নতুন রূপ দিয়েছে; শহরগুলো বাসযোগ্য হয়েছে। তাদের সফলতার অভিজ্ঞতাকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিবেচনায় কাজে লাগানো হবে। সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ সফল হয়েছে।

রাজউক-সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে হাজারীবাগের পুনঃউন্নয়নের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ওই এলাকার মাটি ট্যানারির কারণে ৮ থেকে ২০ ফুট গভীর পর্যন্ত দূষিত। দূষণ নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পুনঃউন্নয়ন করবে রাজউক। প্রকল্পের মাধ্যমে সরু সড়ককে চওড়া করা, পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান তৈরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করা হবে। ছোট ছোট প্লটকে একত্রিত করে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন করা হবে। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ ব্লকভিত্তিক সুউচ্চ ভবন নির্মাণের সুযোগ দেবে। সর্বনিম্ন এক বিঘা আয়তনের ব্লক গঠনের সুযোগ থাকবে। সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ একরের ব্লক তৈরির পরিকল্পনা করেছে রাজউক। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩ বিঘা, ৫ বিঘা, ১০ বিঘা আয়তনের ব্লক তৈরির সুযোগ রয়েছে পুরান ঢাকায়। রাজউক ওই এলাকার ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের চিন্তা করছে।

গত ২৭ আগস্ট গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ‘ঢাকা আরবান রিজেনারেশন’ শীর্ষক প্রকল্পে হাজারীবাগকে পুনঃউন্নয়ন করার বিষয়ে অনুশাসন জারি করেছে। ট্যানারি এলাকারও পুনঃউন্নয়ন করতে বলা হয়েছে রাজউককে। পুরাতন ট্যানারির আয়তন ৬১ একর। সঙ্গে আরও ২৯ একর যোগ করে ১০০ একর জমি নিয়ে হাজারীবাগ পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার পাশে হবে এ আবাসিক জোন। ঝিগাতলা থেকে বেড়িবাঁধের সঙ্গে সংযুক্ত সড়ক তৈরি করা হবে।

১৯৫০ সালে সর্বপ্রথম পুরান ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের পর ছোট-বড়-মাঝারি মিলে আরও প্রায় ২০০ ট্যানারি গড়ে ওঠে। ট্যানারির কারণে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সেবায় হামেশাই বিঘ্ন ঘটত আশপাশের এলাকায়। দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, হাজারীবাগ ও আশপাশের এলাকায় কেউ থাকতে চাইত না। বাড়ির মালিকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ১৯৮০ সালে হাজারীবাগের স্থানীয় লোকজন ট্যানারি স্থানান্তরের আওয়াজ তোলে। বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে হাজারীবাগের ট্যানারির প্লটে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সেবাসংস্থার লাইন বিচ্ছিন্ন করে ট্যানারি মালিকদের সাভারে যেতে বাধ্য করে। তবু এখনো দূষণের জের রয়েছে হাজারীবাগে। হাজারীবাগের বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার উদ্যোগী হয়েছে উন্নয়নে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পুরান ঢাকাবিষয়ক গবেষক ভূগোলবিদ অধ্যাপক হাফিজা খাতুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বাসা পুরান ঢাকার বংশালে; সমস্যাগুলো আমার চেনা। জনসংখ্যা বেড়েছে; জনঘনত্ব বেশি। ঝুঁকিও বেড়েছে। যানজট পুরান ঢাকার প্রধান সমস্যা। কেমিক্যাল গুদামের কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা বেড়েছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই এলাকা মূলত ব্যবসার জায়গা। অল্প জায়গার মধ্যে সব আয়োজন করছে এখানকার মানুষ। ব্যবসার জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করতে হয়। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধার সরঞ্জামাদির চলাচলের কোনো সুযোগ থাকবে না।’

রাজউকের নগর পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার নিরসন হোক চাই। নানা বাধার কারণে রাজউক খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি। এর আগে বংশালে শুরু করলেও তাতে তারা সফল হতে পারেনি। তারা আবার ফিরে এসেছে। সে সময় আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম। যেকোনো কাজের শুরুতে বাধা আসা স্বাভাবিক। তবে ভালোভাবে করতে পারলে সফল হওয়া সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার পুনঃউন্নয়ন পরিকল্পনা রাজউকের খুব ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। ইউরোপের পুরাতন বড় বড় শহর নতুন রূপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। পুরান ঢাকার পুনঃউন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য এ জনবসতিকে মূল্যবান ও দুর্যোগসহনশীল এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, সড়কগুলো সরু ও প্লটগুলো ছোট আকারের। এই এলাকার পুনঃউন্নয়ন হলে পুরান ঢাকার মানুষের অনেক উপকার হবে। কাজগুলো করতে রাজউকের সঙ্গে পুরান ঢাকার মানুষকেও যুক্ত হতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করা যায়। তাহলে উদ্যোগ সফল হবে।’

তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার সঙ্গে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। সেসব অক্ষুণœ রেখে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে পুরান ঢাকা নতুন রূপ পাবে, প্রাণ পাবে। রাজউকের দায়িত্ব সব অংশীজনের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা; তাদের চাহিদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা।’