রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাশিয়া থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়ালি উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে পারমাণবিক জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) হস্তান্তর করে প্রকল্পটির রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম।
গতকাল বৃহস্পতিবার এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আজ সফল পরিণতি লাভ করছে।
ফলে আজ থেকে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের কাতারে শামিল হলো। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলো। বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তিকে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ আগামী দিনে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।
এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আরেকটি পদক্ষেপ। কাজেই আমরা এটাই মনে করি, আজকের বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা নিউক্লিয়ার যুগে প্রবেশ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বন্ধুপ্রতিম রাশান ফেডারেশনের সরকার এবং জনগণের প্রতি, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অসামান্য সহযোগিতা করেছিল এবং আমাদের এই স্বপ্নের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘বাংলাদেশ রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু। আমাদের সম্পর্ক সমতা, পরস্পরের জন্য শ্রদ্ধা ও পরস্পরের স্বার্থ মেনে নেওয়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাশিয়া কাজ করছে। বড় শিল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া সহায়তা করেছে।
গত বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে দুই দেশ। এ প্রকল্পে আমাদের দুই দেশের স্বার্থ জড়িত এবং এটি পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো গভীর করেছে।’
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমুদ্র সম্পদ, এমনকি খনিজ সম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন এবং বিদেশি ও বহুজাতিক কম্পানিগুলো থেকে আমাদের গ্যাসফিল্ডগুলো কিনে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে অনুযায়ী কিছু কাজও হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর এই মেগাপ্রকল্পসহ সব জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে যায়।’
গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর হাতে রূপপুর প্রকল্পকে পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতির সনদ হস্তান্তর করেন রোসাটমের ফার্স্ট ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (নিউক্লিয়ার এনার্জি) এন্ড্রি পেট্রভ। পারমাণবিক জ্বালানির নমুনা (মডেল) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ।
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে পারমাণবিক স্থাপনার স্বীকৃতি অর্জন করল রূপপুর। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবে ৩৩তম সদস্য হলো বাংলাদেশ।
ভিডিও কনফারেন্সে পুতিন বলেন, ‘রাশিয়া শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে না, এই প্রকল্পের পুরো লাইফসাইকেলে আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকব। পারমাণবিক জ্বালানির টেকসই সরবরাহ করা, কারিগরি সেবা ও ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাশিয়া গ্রহণ করেছে।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁরা কেন্দ্রটির মূল প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবেন। এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শুধু পারমাণবিক কেন্দ্রে নয়, অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও তাঁরা কাজ করতে পারবেন।
পুতিন বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বাংলাদেশি ২০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে। এ ছাড়া ভারতীয় বন্ধুরাও আমাদের সাহায্য করছে। দুই দেশের কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে বলে আশা করছি।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, ২০১৩ সালে রোসাটম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ শুরু করে। গবেষণার কাজ শেষ হওয়ার পর ২০১৭ সালে চুল্লির প্রথম ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়। দুই ইউনিটবিশিষ্ট দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন ২০২৪ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন ২০২৬ সালে শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদনে যাওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণে সক্ষম হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কার্বন নির্গমন করবে না, যা সামগ্রিক অর্থে একটি ভালো দিক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘এ এক অনন্য ইতিহাস। আমি গর্বভরে বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহ ও আশীর্বাদ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। তা ছাড়া জনগণের ভালোবাসা ছিল বলেই আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি। পাশাপাশি দুর্দিনে বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার সহায়তার কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে।’ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকল্পের পরিচিতি তুলে ধরেন পরমাণুবিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর। এরপর পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম ব্যাচের হস্তান্তর সম্পর্কিত ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন। এরপর ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল মানিয়ানো গ্রসি। এরপর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ বক্তব্য দেন।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্পটি দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় এক লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। মোট ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এই প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি মোট দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার। দুটি ইউনিটে বিভক্ত এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ ৭০ শতাংশ এগিয়েছে।
রাশিয়া থেকে আসা ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছায়। ইউরেনিয়ামের দ্বিতীয় চালান গতকাল রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছে।