২৭ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার, ১০:৩৯:৪৭ অপরাহ্ন


মোংলা বন্দরে যুক্ত হচ্ছে রেললাইন
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৩-২০২৩
মোংলা বন্দরে যুক্ত হচ্ছে রেললাইন ফাইল ফটো


বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোড সুন্দরবনে পর্যটক আকৃষ্ট ও বন্দরের পণ্য পরিবহন আরও সহজ করতে ৭৩ বছর পর রেলপথ যুক্ত হচ্ছে মোংলা সমুদ্র বন্দরে। এজন্য খুলনা-মোংলা পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এতদিন রেলপথ না থাকার কারণে মোংলা বন্দরের বড় বড় কন্টেনার পরিবহনে সমস্যা হতো। এছাড়া এই রেলপথ চালু হলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানা গেছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা। এই সমুদ্র বন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে ১১ ডিসেম্বর। তখন সুন্দরবনের পশুর নদীর জয়মনিগোল নামক স্থানে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ ‘দি সিটি অব লিয়নস’ প্রথম নোঙ্গর করে। ১৯৫১ সালের ৭ মার্চ জয়মনির গোল থেকে ১৪ মাইল উজানে চালনা নামক স্থানে এ বন্দর স্থানান্তরিত হয়। যেখানে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ বন্দরের কার্যক্রম চলে।
পরে ব্রিটিশ নাগরিক স্যার ক্লাইভ এংনিস পশুর ও শিবসা নদী দীর্ঘ জরিপ করে বন্দরটি চালনা থেকে সরিয়ে মোংলায় স্থানান্তরের সুপারিশ করেন। ১৯৫৪ সালের ২০ জুন বন্দরটি সরিয়ে মোংলা স্থানান্তর করা হয়। মোংলায় স্থানান্তর হলেও চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ নামের এটি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে মার্চ মাসে নাম পরিবর্তন করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয়।
তবে এটি পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্র বন্দর যেখানে কোনো রেলপথ নেই। এ কারণে বন্দরটিতে অন্যান্য দেশের বড় মালবাহী জাহাজ ভেড়াতে আগ্রহী হয় না। তাই বড় বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ানো হয়। এর ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে মোংলা বন্দরের সঙ্গে রেলপথ যুক্ত করার জন্য এর আগে একাধিক পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের আর্থিক সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে ও পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক কর্মকা- সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান। 
এ বিষয়ে মোংলা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মো. মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মোংলা বন্দরটি ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন এই বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ছিল না। এখন খুলনা-মোংলা রেলপথ চালু সড়কপথে পণ্য পরিবহন চাপ কিছুটা কমে যাবে। পণ্য পরিবহন ব্যয় ও সময় অনেক কমে যাবে। এছাড়া একটি বন্দরের নৌ, সড়ক ও রেল পথের মাল্টিমোডাল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্য অনেকটা সহজ হবে বলে জানান তিনি। 
রেলওয়ে সূত্র জানায়, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত প্রায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায় রয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালে জুনের মধ্যে পুরো রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাই নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। দুই দফা ডিপিপি সংশোধনের পর প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৯৪৮ কোটি ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বাকি ১ হাজার ৩১২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকার সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে।   
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মোংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য খুলনা থেকে বাগেরটহাটের মোংলা পোর্ট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পের নির্মাণ অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে ভারত থেকে মালামাল আসতে ও নানা সংকটে শুরুতেই নির্মাণকাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।’ তবে প্রকল্পের মেয়াদ ডিফেক্ট লায়ারলিটি পিরিয়ডসহ ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্যাকেজ ১ রেল লাইন নির্মাণ, প্যাকেজ-২ রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু, প্যাকেজ-৩ টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং সিস্টেম। প্রকল্পের আওতায় লুপ লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার।

এরমধ্যে ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ। রূপসা নদীর ওপরে নির্মাণ করা ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রূপসা রেলসেতু। এই সেতু কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৩১টি ছোট সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। ১০৭টি কালভার্টের মধ্যে ১০৫টি কাজ শেষ হয়েছে। ৯টি ভিইউপির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২৯ এলসি গেটের ২৬টি কাজ শেষ হয়েছে। ৮টি স্টেশন বিল্ডিংয়ের মধ্যে ফুলতলা, আড়ংঘাটা ও মোহাম্মদনগরের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৫টি স্টেশনের মধ্যে কাটাখালী ৮০ শতাংশ, চুলকাটি ৭ শতাংশ, ভাগা ৭২ শতাংশ, দ্বিগরাজ ৯৮ শতাংশ ও মোংলা স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সরেজমিনে মোংলার ভাগাবাজার রেল স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, রেলপথের বিভিন্ন স্থানে স্লিপার ও পাথর বসানোর কাজ চলছে হয়েছে। অনেক স্থানে নতুন রেললাইন বসানোর কাজ করছে নির্মাণ শ্রমিকরা। ভাগাবাজার স্টেশনটি মোংলার রামপাল এলাকায় অবস্থিত। এই ৭২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। স্টেশনে টিনশিটের প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। লুপ লাইনসহ মেইন লাইন বসানো কাজ শেষ হয়েছে। মাস তিনের মধ্যে ভাগা স্টেশনের কাজ শেষ হবে নির্মাণ শ্রমিকরা জানান। তবে এই রেল লাইনটি চালু মোংলা বন্দরসহ পুরো এলাকায় অনেক পরিবর্তন হবে বলে স্থানীয়রা জানান।   
এ বিষয়ে আসলাম মিয়া নামের রামপালের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পদ্মাসেতু চালুর পাশাপাশি মোংলা বন্দরে রেলপথ যুক্ত হলে মোংলা বন্দরের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে খানজাহান আলী বিমানবন্দর এবং চাহিদামতো গ্যাস মিললে ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন। খুলনার হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পর্যটনশিল্প থেকে আয় আরও বাড়বে। দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।’