হঠাৎ দেশে শুরু হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। রাজনৈতিক সহিংসতা ছাড়াও পেশাদার সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করছে এসব অস্ত্র। কেউ কেউ ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করেও চালাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সীমান্তের ফাঁক গলিয়ে অস্ত্র ঢুকছে দেশে। এ অবস্থায় এখনই লাগাম টানতে চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাইপথ—এমন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ব্লক রেইড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর দেশের ভেতরেও সাঁড়াশি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি জেলার ওপর থাকবে তীক্ষ্ণ নজর। রাজনৈতিক সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বা আশঙ্কা রয়েছে—সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে জেলাগুলো নির্ধারণ করেছেন গোয়েন্দারা। রাজনৈতিক উত্তাপ-অস্থিরতা ছড়ানোর আগেই টানা অভিযান চালিয়ে লাগাম টানতে চায় সরকার। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বুধবার থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার কথা। তবে সমন্বিত প্রস্তুতির জন্য আরও কয়েক দিন বিলম্বও হতে পারে। এই অভিযানে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকটি ইউনিটও অংশ নেবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. হায়দার আলী খান গত সোমবার কালবেলাকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধার পুলিশের রুটিন কাজ। এই অভিযান সব সময়ই চলমান। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আরেকটা সাঁড়াশি অভিযান চলানোর নির্দেশনা রয়েছে। সেটার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। বিশেষ শাখার (এসবি) তৈরি করা প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দেশে গুলির ঘটনা ১৫০ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে পাঁচজনেরও বেশি।
সম্প্রতি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, একটি চক্র ভুয়া লাইসেন্স করে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চক্রটি দেশব্যাপী এই জালিয়াতি ছড়িয়ে দিয়েছে। র্যাব বিপুলসংখ্যক জালিয়াতির এসব লাইসেন্স জব্দ করেছে। উদ্ধার করেছে অবৈধ অস্ত্র।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দেশে অস্ত্র ঢুকেছে বলে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বড় অভিযান চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বেআইনি অস্ত্র খুব অ্যালার্মিং। অনেকে অস্ত্রের জাল লাইসেন্স বানিয়ে নিয়েছে। লাইসেন্সের সত্যতা যেন যাচাই করা হয়, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বড় আকারে যেন অভিযান চালানো হয়, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক থাকবে।
সীমান্তে ব্লক রেইডের পর গুরুত্বপূর্ণ ২০ জেলায় অভিযান : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, ছোট ছোট আগ্নেয়াস্ত্র সীমান্ত দিয়েই দেশে ঢুকছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, পেশাদার, গুপ্ত খুনি ও রাজনীতির নাম ব্যবহার করা সন্ত্রাসীদের হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে অস্ত্র। তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমান্তবর্তী ৩২ জেলায় ব্লক রেইড দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এসব সীমান্ত জেলার মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৩০টি এবং মিয়ানমার সীমান্তে রয়েছে দুটি জেলা। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাগুরা ও বরগুনা—এই ২০ জেলায় থাকবে কঠোর নজরদারি।
অবৈধ অস্ত্রের বেশি অপব্যবহার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে : মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারিতে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ প্রায় ২০টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুজন নিহত ও ২১০ জন আহত হন। সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনায় গুলি চালানো হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর শিবপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করা হয়। দলীয় কোন্দলে দ্বিধাবিভক্ত স্থানীয় রাজনীতির কারণে ওই গুলির ঘটনা বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশের দেশীগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, রাজনৈতিক কোন্দলে তাকে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা জেলায় : রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সংঘর্ষ ঠেকাতে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে আরও বেশি তৎপর হতে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। প্রতিটি থানায় চিহ্নিত দুষ্কৃতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে বা আশঙ্কা রয়েছে, সেই তালিকা করা হয়েছে। এসপিদের এ বিষয়ে অবগত করা হচ্ছে।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ সূত্র বলছে, বিভিন্ন সংঘর্ষে যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, এর বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ। ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব সংঘর্ষ হচ্ছে।
জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, শাসক দলের সঙ্গে অধিক ‘ঘনিষ্ঠতার’ কারণে অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
যেভাবে দেশে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও নাইন এমএম পিস্তল বেশি ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। আর পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলবার আসছে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে। কুমিল্লা, যশোরের বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত হয়েও নানা ধরনের অস্ত্র ঢুকছে দেশে।
সীমান্তে চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে, তা অস্বীকার করছে না বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ৩২৮ কিলোমিটার স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে যশোরের শার্শা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হিলি, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অন্যতম। তথ্য বলছে, এই সীমান্তগুলোর অন্তত ৩২ পয়েন্ট দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকে।
বিজিবি পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতি মুহূর্তে সীমান্তে বিজিবির ৬ হাজার সদস্য টহলে থাকে। এর মধ্যেও অস্ত্র আসছে। আমরা অস্ত্র কারবারিদের নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টা করছি। এ নিয়ে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গেও আলোচনা চলছে।’
সার্বিক বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, নির্বাচনের এত আগে চারদিকে এমন সহিংসতা খুবই দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের এখন শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের বাইরেও পুলিশের মৌলিক যে কাজ আছে, তা চালিয়ে যেতে হবে।