স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রোগীদের অভিযোগ তদারকিতে হেলথ রেগুলেটরি কমিশন হচ্ছে। জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং সংবিধানে উল্লিখিত স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করাই হবে এ কমিশনের কাজ। এ কমিশন গঠনে একটি খসড়া আইন তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর প্রাথমিক খসড়া আইনের কপিটি গত ৬ নভেম্বর হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।
খসড়া আইনে কমিশনের কার্যাবলি ও তদন্ত-সম্পর্কিত তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কমিশন যে কোনো স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অবাধে ও বিনা বাধায় তদন্ত করতে পারবে। যে কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপের সুপারিশ করতে পারবে। চিকিৎসার গাফিলতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা কর্তৃপক্ষকে অর্থদণ্ড প্রদান করতে পারবে এবং সেই অর্থ রোগীর কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিতে পারবে। চিকিৎসার খরচের আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশ ফেরত এবং কমিশন প্রদানের আদেশ দিতে পারবে। এভাবে মোট ১৯ দফা কার্যাবলি ও তদন্তের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে খসড়া আইনে। আইনে মোট ৩১টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, দেশের স্বাস্থ্য খাত নানা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। স্বাস্থ্যসেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও তার স্বজনরা। অপচিকিৎসায় প্রায়ই রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমতো ফি আদায়, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এসবের প্রতিকারের জন্য রোগীদের যাওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা নেই।
এমনই এক প্রেক্ষাপটে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ও দুর্ভোগের প্রতিকার দিতে ‘হেলথ রেগুলেটরি কমিশন’ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে এক আবেদন করা হয়। পরে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর হাইকোর্ট এ ব্যাপারে রুল জারি করেন। রুলে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা নিয়ে রোগীদের অভিযোগ তদারকির জন্য হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালকসহ (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এ রুল বিচারাধীন থাকাবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠন আইন-২০২২’ খসড়া প্রণয়ন করেছে। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চে গত ৬ নভেম্বর এ খসড়া দাখিল করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রিটকারী আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রোগীদের দুর্ভোগ শোনার জন্য কেউ নেই। সে কারণে হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করি। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ কমিশন গঠনের একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে। হাইকোর্ট খসড়া আইনটির ওপর আমার লিখিত মতামত চেয়েছেন। শীতকালীন অবকাশের পর আগামী জানুয়ারিতে বিষয়টি ফের কার্যতালিকায় আসবে। এর আগেই আমি এ খসড়া আইনের ওপর লিখিত মতামত দেব।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে খসড়া আইনটি দেখে আমার মনে হয়েছে, কমিশন গঠন হলেও সুপারিশ করা ছাড়া কমিশনের তেমন কোনো কার্যকর ক্ষমতা থাকবে না। আরও ত্রুটিবিচ্যুতি যা আছে খসড়া আইনে, তা তুলে ধরা হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যান ও অনধিক ছয় সদস্যের সমন্বয়ে এ কমিশন হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য সার্বক্ষণিক এবং অন্য সদস্যরা অবৈতনিক হবেন। সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে একজন মহিলা ও একজন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য হবেন।
চেয়ারম্যান নিয়োগের ব্যাপারে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটির সুপারিশে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ করবেন। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে এবং ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে হলে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। আইন বা বিচারকাজ, শিক্ষা, মানবাধিকার, চিকিৎসা, সমাজসেবা ও মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন, এমন ব্যক্তিরাই নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন। চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নিয়োগ লাভের পর তিন বছর স্বীয় পদে থাকবেন। তবে কেউ দুই মেয়াদের বেশি নিয়োগ পাবেন না।
কমিশন বাছাইয়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে, স্পিকারের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি হবে। আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং স্পিকার কর্তৃক মনোনীত দুজন এমপি বাছাই কমিটির সদস্য হবেন। কমিশনের চেয়ারম্যানরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সমান বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং সার্বক্ষণিক সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের সমান সুযোগ-সুবিধা পাবেন। অবৈতনিক সদস্যরা কমিশনের সভায় যোগদান ও অন্যান্য কাজের জন্য কমিশন থেকে নির্ধারিত হারে ভাতা পাবেন।
কমিশনের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে—কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা সরকারি-বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক সেবাগ্রহীতার অধিকার লঙ্ঘনের প্ররোচনা সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ স্বতঃপ্রণোদিত বা আবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত করবে। সেবাগ্রহীতার অধিকার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা বা অনুরূপ লঙ্ঘন প্রতিরোধে অবহেলা সম্পর্কিত অভিযোগ তদন্ত করবে। চিকিৎসাসেবার জন্য মানুষকে আটকে রাখা হয়—এমন স্থান পরিদর্শন করে সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। খসড়া আইনে কমিশনের মোট ১৯ দফা কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে। যার অধিকাংশই তদন্ত করে সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া কমিশনের কার্যাবলি ও তদন্ত-সম্পর্কিত তৃতীয় অধ্যায়ে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কমিশন যে কোনো স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অবাধে ও বিনা বাধায় তদন্ত করতে পারবে। যে কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপের সুপারিশ করতে পারবে। চিকিৎসার গাফিলতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা কর্তৃপক্ষকে অর্থদণ্ড প্রদান করতে পারবে এবং সেই অর্থ রোগীর কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিতে পারবেন। চিকিৎসার খরচের আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশ ফেরত এবং কমিশন প্রদানের আদেশ দিতে পারবে। চিকিৎসা, রোগ নির্ণয় বা আনুষঙ্গিক বিষয়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করলে ন্যায়সংগত অর্থ ফেরতের আদেশ প্রদান ও অন্যান্য দণ্ডও প্রদান করতে পারবে। যে কোনো ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থাকে নির্দেশনা বা সংশোধিত আদেশ প্রদান করতে পারবে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট কোনো ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কমিশনে পাঠাতে পারবেন।