প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বহুমুখী জ্বালানি সহযোগিতা গড়ে তুলছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অনেকগুলো চুক্তিও সই হয়েছে। এখন পাইপলাইনে আরএলএনজি আমদানির চেষ্টা চলছে। ভারত থেকে খুলনা দিয়ে একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি সরবাহ করা হবে। এ ছাড়া নতুন করে ভারতের আসাম থেকে পাইপলাইনে জ¦ালানি তেল আমদানির কথাও ভাবছে সরকার।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে ইতোমধ্যে সরকার এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। যার মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট পশ্চিম বাংলা হয়ে পাবনা দিয়ে আমদানি করা হচ্ছে। আর ১৬০ মেগাওয়াট আসছে ভারতের ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লার সূর্যমনি দিয়ে। এদিকে ভারতের নুমালীগড় থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল (ডিজেল) আমদানি করতে দিনাজপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। আগামী বছরের শুরুর দিকে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক
উদ্বোধনের আশা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা যাবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ আড়াই লাখ টনের মতো ডিজেল আমদানি করবে এবং পরের বছরগুলোতে এটি ৪ থেকে ৫ লাখ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। চুক্তির অধীনে সরবরাহ শুরুর দিন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ডিজেল নেবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ২ হাজার ২০০ টন ডিজেল আমদানি করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে এই ডিজেল পার্বতীপুর তেল ডিপোতে জ্বালানি বহন করে বিপিসি এবং পরে তা গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয়।
এ ছাড়া আগামী মার্চ/এপ্রিলের দিকে ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আদানী পাওয়ারের কাছ থেকে প্রায় ১৬শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। সর্বশেষ ভারতের আসাম থেকে সিলেট দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সরকার।
জ¦ালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুরের বাজার থেকে জ¦ালানি তেল আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুরো বিশ্বে জ্বালানি তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ফলে জ্বালানি বিভাগের ভাবনার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল বা জ্বালানি পণ্য আমদানির একাধিক সোর্স বা উৎস বের করা।
বিষয়টি সর্ম্পকে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ অঞ্চলে বাংলাদেশই প্রথম প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ক্রসবর্ডার এনার্জি সহযোগিতার বিষয়টি চালু করেছে। তিনি বলেন, আমরা পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নিজেরা লাভবান হতে পারি। শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে কাজ করা হচ্ছে। নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ভারতের আসাম থেকে জ্বালানি তেল আমদানির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, আসামে ভারতের একটি বৃহৎ রিফাইনারি হাব রয়েছে। আসাম থেকে সিলেট হয়েও পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনা সম্ভব। এ বিষয়ে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে কিনা বা মন্ত্রণালয়ের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা তা তিনি জানতে চেয়েছেন।
ওই বৈঠকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানিয়েছেন, আসাম থেকে ট্যাংকারের মাধ্যমে জিটুজির ভিত্তিতে জ্বালানি তেল আনার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ের দিকে রয়েছে। চেয়ারম্যান কমিটিকে আরও জানিয়েছেন আসাম থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি আমদানিতে অর্থনৈতিক ও ভূতাত্ত্বিক বিষয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় আছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানিয়েছে, আগামীকাল বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নিয়ে জ্বালানি বিভাগে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে পাইপলাইন নির্মাণের সর্বশেষ অবস্থা এবং কবে নাগাদ পাইপলাইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা যাবে সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এদিকে ভারত থেকে ক্রসবর্ডার পাইপলাইনের মাধ্যমে আরএলএনজি আমদানির চেষ্টা করছে সরকার। পেট্রোবাংলা ইতোমধ্যে ভারতের আওইসিএল এবং এইচ-এনার্জির সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি বা এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। এইচ-এনার্জির প্রস্তাব বিচেনায় নিয়ে চুক্তি প্রক্রিয়াকরণের জন্য সরকার নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছে। এইচ-এনার্জি থেকে আরএলএনজি আমদানির জন্য খসড়া গ্যাস সেলস অ্যাগ্রিমেন্ট (জিএসএ) চূড়ান্ত করেছে সরকার। জ্বালানি বিভাগ বলছে, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাইপলাইনে আরএলএনজি আমদানি চূড়ান্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, দেশে জ্বালানির সংকট প্রকট হয়ে আছে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির সংকটের কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট সমাধানের আবেদন জানানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সমাধানের আশ^াস দেওয়া হচ্ছে। তবে কার্যত তেমন সমাধান হচ্ছে না। গত কয়েক মাস যাবৎ দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্যাস সংকটে প্রায় বন্ধ থাকছে।
রাজশাহীর সময় বলছে, দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হতো। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমেই এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে চারটি করে এলএনজি কার্গো আমদানি করা হয়েছে। তবে ডিসেম্বর মাসে ৫টি এলএনজির কার্গোা আমদানি করা হবে। ফলে গ্যাসের সংকট অনেকটা কমবে।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক তিন হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যার বিপরীতে এলএনজিসহ প্রতিদিন গড়ে ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তবু চাহিদার তুলনায় এ সরবরাহ অনেক কম।