১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:২২:২৪ পূর্বাহ্ন


তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন পেশ গুমের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা
অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১২-২০২৪
তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন পেশ গুমের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন পেশ গুমের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা


গুমের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত এ সংক্রান্ত কমিশন। এ কাজে শেখ হাসিনা ছাড়াও প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা মিলেছে কমিশনের তদন্তে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও করেছে কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছেন কমিশনের সদস্যরা।

শনিবার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্স) প্রধান উপদেষ্টার কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তদন্ত কমিশনের সদস্যরা ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি জমা দেন। কমিশন সদস্যরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ১৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেন বলে জানিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এছাড়াও হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে আছেন-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম (ভুক্তভোগী) বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়ন করেছে।

তিনি আরও জানান, গুমের শিকার অনেকে এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তাদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল যে তারা এখনো ট্রমায় ভুগছেন। প্রধান উপদেষ্টা তার সর্বশেষ বক্তব্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর রিপোর্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কমিশনের সদস্যরা অধ্যাপক ড. ইউনূসকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। তারা বলেন, ‘আপনি আয়নাঘর পরিদর্শন করলে ভিকটিমরা অভয় পেতে পারেন।’ প্রধান উপদেষ্টা তাদের এ অনুরোধে সম্মতি দিয়ে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল যা আয়নাঘর নামে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলো দেখতে যাবেন। তিনি কমিশন সদস্যদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কাজটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তারা ৩ মাস পর মার্চে আরও একটি ইন্টেরিম রিপোর্ট দেবেন। কাজটি শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন বলে জানান তিনি। কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন-গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় গুমসংক্রান্ত কমিশন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশনের অন্যরা হলেন-হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশনের বিবেচনায় আনা হয়েছে। কমিশন গঠনের পর কয়েক দফা অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর অভিযোগ দায়েরের সময় শেষ হয়েছে।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে জানা যায়- আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা এবং অনুরূপ যে কোনো বাহিনী বা সংস্থার কোনো সদস্য বা সরকারের মদদে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি কর্তৃক আয়নাঘর বা যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত স্থানে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করা; তাদের শনাক্ত করা; কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল, তা নির্ধারণ করা এবং সে উদ্দেশ্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যসহ যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা কমিশনের অন্যতম কাজ। বলপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবহিত করাও এ কমিশনের কাজ। কমিশন গুম ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবে। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বাংলাদেশের যে কোনো স্থান পরিদর্শন এবং যে কোনো ব্যক্তিকে কমিশনে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।

জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ব্যক্তি বা তার স্বজনরা গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ভুক্তভোগী নিজে, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজন এবং গুম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। কেউ সশরীরে গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে আবার কেউ ডাকে অথবা ই-মেইলে অভিযোগ করেন। বেশিরভাগ ঘটনায় অভিযোগের তির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিকে। কখনো প্রকাশ্যে বাহিনীর পোশাক পরে আবার কখনো সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকের আর হদিস মেলেনি। অনেকের স্বজন বছরের পর বছর মামলা লড়ে ক্লান্ত আবার অনেকে আইনের আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ পাননি। নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তাও জানেন না। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর বেশিরভাগই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অবশেষে স্বজন ফেরার অপেক্ষা ঘোচানোর প্রত্যাশায় গুমসংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ করেছেন তারা।

গুম হওয়াদের সন্ধানে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ১৫৫ জন এখনো ফিরে আসেননি। এ সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি যুগান্তরকে জানান, না ফেরাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় ৩০০ ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

তিনি বলেন, গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায় আছেন, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর আগের সরকার দেয়নি। এমনকি তাদের নিয়ে ঠাট্টা পর্যন্ত করেছে। আমাদের বর্তমানে চাওয়া হলো, এখন পর্যন্ত যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের যেন ফেরত দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রতিটি গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অগণিত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক, যে বাহিনীরই হোক, তাদের ডাকার ক্ষমতা কমিশনের আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীদের কাছে যত অভিযোগ আছে, তা সংগ্রহ করছি। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে-প্রমাণ করা যে এখানে গুম হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে-কে গুম করেছে, তা প্রমাণ করা।’

অভিযোগকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে যুগান্তরের। এমন একজনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাসা থেকে র‌্যাবের পোশাক পরা একদল সশস্ত্র লোক বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে তুলে নিয়ে যান। নিখোঁজের কিছুক্ষণ পরেই খবর পায় পরিবার। এরপর থেকে র‌্যাব অফিস, ঘটনার আশপাশের থানা, ডিবি অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুমনের সন্ধান দিতে পারেননি কেউ। এ ঘটনায় থানা মামলা পর্যন্ত নেয়নি। অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ করেছেন সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি।

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকা থেকে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি অপহরণ হন ব্যবসায়ী মো. কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী। সাদা পোশাকে একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যান। এখনো ফিরে আসেননি এ ব্যবসায়ী। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, তাও জানেন না স্বজন। ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬ জনের নামোল্লেখ করে মামলা করেন স্ত্রী মোছা. জোসনা বেগম। ১১ বছর মামলা লড়তে কোর্ট-কাচারি ঘুরে ক্লান্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব স্ত্রী জোসনা। শেষ ভরসা হিসাবে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে ২৪ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী কুদ্দুসের মেয়ে ফারজানা আক্তার টুম্পা।

তথ্য সূত্র; যুগান্তর।