২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৫:১০:৪৮ পূর্বাহ্ন


বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম নামলেও দেশে চড়া
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৯-২০২২
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম নামলেও দেশে চড়া ফাইল ফটো


অতিমারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গেল এক বছরে বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ধীরে ধীরে বেশিরভাগ পণ্যের দাম পড়তে থাকলেও বাংলাদেশ হাঁটছে দামের চড়া পথে। দেশের বাজারে বাড়তি দাম তো কমেইনি, উল্টো কিছু কিছু পণ্যে দর বেড়েছে আগের চেয়ে আরও বেশি। এতে করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সংসারের চাকা ঘোরাতে খাবি খাচ্ছে।

বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম ৬ থেকে ১৯ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ১০ থেকে ৬৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক ও দেশের পণ্যবাজারের দামের এমন বিস্তর ফারাকের ছবি উঠে এসেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের বর্তমান চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির বিস্তারিত তথ্য। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ মহলে পাঠানো হয়েছে প্রতিবেদনটি।

প্রতিবেদনে নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল, আটা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে দেখানো হয়েছে রড ও সিমেন্টের তুলনামূলক দামের চিত্র। এ ছাড়া রয়েছে জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজার ও দেশের দামের ব্যবধান।

এদিকে উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে কিছু খাতের ব্যবসা লোকসানে রয়েছে। এ ছাড়া কিছু সিন্ডিকেট ও মজুতদারের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে এখন বিশ্ববাজারে দাম কমছে, ভোক্তারা এর সুফল পাবেন আরও দেড় থেকে দুই মাস পর।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি) এ কে এম আলী আহাদ খান বলেন, বিশ্ববাজার পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যসহ অন্য জিনিসপত্রের দাম সমন্বয় করার দায়িত্ব ট্যারিফ কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে তিন-চার দিন আগে বৈঠক হয়। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে তাদের ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা বিচার-বিশ্নেষণ করে দেশের বাজারে পণ্যের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে।

বিশ্ববাজারের চেয়ে চালের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ, আটা ৮ গুণ: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল এক বছরে বিশ্ববাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ, তবে দেশে বেড়েছে ১৩ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৭ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ১০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। বিশ্ববাজারে এই মানের চালে দাম বেড়েছে ৭ শতাংশের কিছু বেশি। বিপরীতে বাংলাদেশে বেড়েছে ১৯ শতাংশ। তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, এক বছরে বিশ্ববাজারে গড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। তবে দেশে বেড়েছে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১৪ শতাংশ।

একইভাবে আটার দামেও দেখা গেছে বড় উল্লম্ম্ফন। এক বছরে আটার দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৮ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে বেড়েছে এর ৮ গুণের বেশি, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশ।

উৎপাদনকারীরা বলছেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে মূল কারিগর কিছু সিন্ডিকেট ও মজুতদার। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচআর খান পাঠান সাকি বলেন, মিল মালিকরা ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে আড়তদারদের মোটা চাল সরবরাহ করে। সেই চাল পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা হয়ে তিন হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে যায়। ফলে দাম বেড়ে যায়। তবে এত দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোরশেদ আলম খান বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বিনিয়োগের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বহু চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে কিছু সিন্ডিকেট ও মজুতদারের হাতে চলে গেছে চালের বাজার। এ কারণে দাম বেড়ে যায়। তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া চালকলগুলোকে ঋণ-সহায়তা দিয়ে ফের চালু করা প্রয়োজন। তাহলে চালের বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। দামও ভোক্তার নাগালে চলে আসবে।

মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও চিনির দামে উল্টো বাঁক: মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। তবে বাংলাদেশে দাম না কমে উল্টো অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে ডালের দাম গড়ে কমেছে ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে বড় দানার মসুর ডালের দাম ৩৯ শতাংশ এবং মাঝারি ও ছোট দানার ডালের দাম প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে দেশে ৯ শতাংশ দাম বেড়েছে পেঁয়াজের, যা বিশ্ববাজারে কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে গড়ে দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এ সময় দেশে চিনির দামও বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ।

ভোজ্যতেলের দামে বড় খেলা: এক বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির থাকা ভোজ্যতেল নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, গেল পাঁচ বছরে খোলা তেলের লিটারে ৭৫ টাকা ৫০ পয়সা এবং বোতলজাত তেলে ৮৩ টাকা ২৫ পয়সা দাম বেড়েছে।

এতে বলা হয়, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ টনের। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় দুই লাখ টনের কিছু বেশি। আমদানি হয় ১৮ লাখ টন। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি ৫ লাখ টন। এ ছাড়া ২৪ লাখ টন সয়াবিন বীজ আমদানি হয়, যা থেকে চার লাখ টন অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হয়। আর অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয় ১১ লাখ টন।

আমদানির দিক থেকে পাম অয়েল বেশি হলেও ২১ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ১৫টিই নিজেদের প্রস্তুত করা খাদ্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে। বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠান আমদানি করা তেল বাজারে সরবরাহ করে।

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত ও নাইজেরিয়া থেকে পাম অয়েল এবং প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও তুরস্ক থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। সংকটকালে আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তেল আমদানির সুযোগ রয়েছে। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে সরিষা, রাইস-ব্র্যান, অলিভ, সূর্যমুখী, নারিকেল ও চীনাবাদামের তেলের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।

ভোজ্যতেলের দামের চিত্র তুলে ধরে গোয়ন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বশেষ গত ২৩ আগস্ট ভোজ্যতেলের দাম বাড়ান এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৫, বোতলজাত প্রতি লিটার ১৯২, ৫ লিটারের বোতল ৯৪৫ এবং পাম অয়েলের লিটার ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দেন। তবে কোথাও কোথাও এই দরের চেয়েও দুই থেকে পাঁচ টাকা বেশি দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।

গত পাঁচ বছরের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার একটি বিবরণ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে খোলা প্রতি লিটার তেলের দাম ছিল ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা। এর পরের বছর কিছুটা কমে ৮৮ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে আসে। এর পর থেকে বাড়তেই থাকে। ২০২০ সালে ১০১, ২০২১ সালে ১৪০ টাকায় লিটার বিক্রি হয়। অন্যদিকে বোতলজাত প্রতি লিটারের দাম ২০১৮ সালে ছিল ১০৮ টাকা ৭৫ পয়সা। কিছুটা কমে ২০১৯ সালে হয় ১০৪ টাকা। এরপর ২০২০ সালে ১১৩ টাকা ৭৫ পয়সা এবং ২০২১ সালে ১৪৫ টাকায় পৌঁছায়।

আটা, মসুর ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের দামের ফারাকের ব্যাপারে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টসের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয়) মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, গম আমদানিতে বেঘাত ঘটার কারণে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে। সামনে গম আমদানিতে সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশে এখন যেসব আমদানি করা নিত্যপণ্য বেচাকেনা হচ্ছে, সেগুলো অন্তত দুই-তিন মাস আগের আমদানি করা। তবে বিশ্ববাজারে যেহেতু এখন খাদ্যপণ্যের দাম কমছে, দেশেও কমবে। সে জন্য দেড় থেকে দুই মাস অপেক্ষা করা লাগতে পারে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও প্রতিবেশী দেশের চেয়ে কম: জ্বালানি তেলের দাম পাশের দেশ ভারত ও নেপালের চেয়ে কম বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মাসখানেক আগে দেশে প্রতি লিটার পেট্রোলের ৪৪, ডিজেল ও কেরোসিনের ৩৪ এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোল ১৩০, ডিজেল ১১৪, অকটেন ৮৯ ও কেরোসিন ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এই দর ভারত ও নেপালে কিছুটা বেশি। ভারতে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ১২৫ থেকে ১৩১, ডিজেল ১১৩ থেকে ১২০, অকটেন ১৬০ এবং কেরোসিনের দাম ১১৪ থেকে ১১৯ টাকা। অন্যদিকে নেপালে প্রতি লিটার পেট্রোল ১৩৫ টাকা ৬৬ পয়সা, ডিজেল ১২৮ টাকা ৬৩ পয়সা এবং কেরোসিন ১২৮ টাকা ৬৩ পয়সায় বিক্রি হয়।

রডের দাম বিশ্ববাজারে কমেছে ১৪ শতাংশ, দেশে বেড়েছে ১৬ শতাংশ: নিত্যপণ্য, জ্বালানি তেলের পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার চিত্র তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। দেশে এসএম রডের চাহিদা রয়েছে ৮০ লাখ টনের, যার সিংহভাগই উৎপাদন হয় দেশে। বিশেষায়িত কিছু রড আমদানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৬ লাখ টন। এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে রড উৎপাদনের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ স্টিলের দাম বাড়লেও গত জুলাইতে তা কমে দেড় বছর আগের অবস্থানে ফিরে যায়। জুলাইয়ে কমে প্রতি টনের দাম ৪০০ ডলারের নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ গত এক বছরে বিশ্ববাজারে রডের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে দাম না কমে বরং বেড়েছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ।

এ ব্যাপারে পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে রড তৈরির কাঁচামাল স্ট্ক্র্যাপের দাম বেড়েছিল। প্রতি টন স্ট্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়েছে গড়ে ৭৫০ ডলারে। এর সঙ্গে শুল্কায়ন প্রায় ৫ হাজার এবং উৎপাদন খরচ ২০ হাজার টাকা ধরলে এক লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা রডের টন। তবে এখন টন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ হাজারের কিছু বেশি দামে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে রড ব্যবসায়ীরা লাভে নয়, বরং লোকসানে আছেন। তবে এখন যেসব স্ট্ক্র্যাপ আমদানি হচ্ছে, সেগুলোর দাম তুলনামূলক কম। আগামী দুই-তিন মাস পর এর সুফল পাবেন ক্রেতারা।

সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ: দেশে বছরে ৩৩৬ লাখ ৫০ হাজার টন সিমেন্টের ব্যবহার হয়, যার সিংহভাগই স্থানীয়ভাবে আমদানি হয়। রডের মতো বিশেষায়িত কিছু সিমেন্ট আমদানি হয়। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে দেশে বেড়েছে ৩১ শতাংশ। সূত্র:সমকাল