ইসলাম নারীকে কি বন্দি করেছে? ঘরের ভেতর আবদ্ধ হয়ে থাকতে বলেছে? শিক্ষা ও প্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি করেছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- না; ইসলামে নারীকে আবদ্ধ করা হয়নি, বন্দি করা হয়নি এবং নারীর উন্নতি ও অগ্রগতিতে কোনো বাধার সৃষ্টি করা হয়নি। ইসলামে পর্দার বিধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্দাকে এখন যেভাবে প্রকাশ করা হয় তাতে অনেক সময় মনে হয় পর্দা বুঝি নারীকে বন্দি করার জন্যই নাজিল হয়েছে, অথচ বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। পর্দা কেবল নারীর নয়, নারী পুরুষ সবার জন্যই পর্দার বিধান। পুরুষের ড্রেস কোড আছে, ইসলামে নারীরও কিছু ড্রেস কোড আছে। ড্রেসকোডের বাইরে কিছুই নয়। কিন্তু এখন কোথাও ধর্ষণ হলেই বলা হয় যদি সে বোরখা পরতো তাহলে ধর্ষণ হতো না। এসব বলে কি ইসলামের পর্দা বিধানের সঠিক তাৎপর্য নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে না। কোনো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ড্রেসকোড অনুসরণ না করার কারণে সেই প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে অপরাধ করতে পারে। কিন্তু ড্রেসকোড লঙ্ঘন করার কারণে অন্য কারও অপরাধের দায় তার উপর চাপানোর কোনো সুযোগ থাকে না। পোশাকের বিধান তার স্বস্থানে, নারীর ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট করার অপরাধ পৃথকভাবে শাস্তিযোগ্য। এভাবে মনগড়া হেকমত বের করে ইসলামি বিধি বিধানের সঠিক তাৎপর্য নষ্ট করা হয়।
কয়েক বছর আগে একজন বড় স্কলার বলেছিলেন, মেয়েদের এতটুকু শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা স্বামীর টাকা পয়সা ঠিকমত হিসেব করে রাখতে পারে। ক্লাস ফাইভের পর তাদেরকে আর পড়ানোর প্রয়োজন নেই। এমন চিন্তা এখনও আছে আমাদের সমাজে। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষই মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে চান না। অথচ শিক্ষা নারীর এক মৌল অধিকার। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে ইসলামে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নারী ও পুরুষের উপর সমানভাবে ফরজ। হালাল হারাম ও প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞানও অর্জন করতে হবে মুসলিম নারীকে। এর জন্য আমাদের সামনে নবী যুগের নারীদের ইতিহাস আছে। অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। স্বয়ং মহানবী (সা.)-এর ঘরেই খুঁজে দেখতে পারি। রাসুল (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীগণ সবাই ছিলেন একেকজন বিদুষী। রাসুল (সা.) তাদেরকে বিদ্যোৎসাহী করে গড়ে তুলেছেন। পুরুষ সাহাবিরা সবাই মিলে যেখানেই সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হতেন সেখানেই নবীজীর স্ত্রীদের কাছে লোক পাঠিয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে হযরত আয়শা ও উম্মে সালামা (রা.)-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা উচু স্তরের ফকিহা ছিলেন। হযরত আয়শা (রা.) রাসুল (সা.) থেকে প্রায় আড়াই হাজার হাদিস বর্ণনা করেছেন। এছাড়া তার ব্যক্তিগত ফতোয়া রয়েছে বহু মাসআলায়। অন্য সাহাবিদের উপর রিমার্ক করে অনেক মাসআলা দিয়েছেন। পরবর্তী মনীষীরা বলেছেন, হযরত আয়শা অন্য পুরুষ সাহাবিদের রদ করে যেসব ফতোয়া দিয়েছেন সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব ফতোয়ার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হযরত আয়শার কথাই সঠিক। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কোনো আলেম বা ইসলামি স্কলার কোনো ভুল কথা বললে তা গ্রহণ করা জায়েয নয়।
ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট আলেমের কথায় চলে না। ইসলামের প্রতিষ্ঠিত সত্য রয়েছে, আমাদের অবশ্যই কোরআন সুন্নাহর আলোকে তা যাচাই করে দেখতে হবে। আপনি কোনো আলেমকে ভক্তি করতেই পারেন, কিন্তু তার কথাকে আপনি কোরআন হাদিস মনে করতে পারেন না। কোনো বড় আলেম বা পীর বা বক্তা ভুল করলে সেটিকে ভুল বলা শিখতে হবে। ইসলাম আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। হযরত উমরের মত সাহাবির সিদ্ধান্ত একজন বৃদ্ধা মহিলা কিভাবে রদ করে দিয়েছিল ইতিহাসের গ্রন্থে দেখুন। একবার মসজিদে নববিতে হযরত উমর মেয়েদের মহর বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি অতিরিক্ত মহর ধার্য করতে নিষেধ করেন। কড়া কথা শোনান। এ সময় এক বৃদ্ধা মহিলা বলে উঠেন, হে উমর আমরা আপনার কথা মানতে পারি না, যেখানে পবিত্র কোরআন আমাদেরকে ইচ্ছামত মহর ধার্য করার একতিয়ার দিয়েছে, সেখানে আপনি কে আমাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করার? আমাদের অধিকার খর্ব করার একতিয়ার আপনাকে কে দিল? হযরত উমর বৃদ্ধার কথা মেনে নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে রুজু করেন। অনুতপ্ত হন এবং নিজের ভুল স্বীকার করেন। এমন অসংখ্য ঘটনা আছে ইসলামের সোনালি যুগের ইতিহাসে। এখনকার দিনে দেখা যায় শ্রদ্ধেয় কোনো স্কলার কিছু বললে সেটিকেই শেষ কথা মনে করা হয়, যাচাই করে দেখার মত সৎ সাহস থাকে না। এটা কোনো ইসলামি মানসিকতা নয়। ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে গ্রহণ করতে হবে স্কলারদের কথা।
আজকের দিনে নারীদের প্রতি ধর্মীয় অঙ্গনেও যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় তা সত্যি দুঃখজনক। রাসুল (সা.) নারীদেরকে মসজিদে হাজির হতে বাধ্য করেননি। কিন্তু মসজিদে নববিতে নারীদের সরব উপস্থিতি ছিল। নারীদের জামাতে হাজির হতে বাধ্য না করার কারণ তাদের প্রতি বৈষম্য নয়, বরং তাদের ইবাদতকে সহজ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এখন আমাদের সমাজে এর এতটাই ভিন্ন অর্থ করা হয়েছে যে, মেয়েদের জন্য কোথাও নামাজের জায়গাই থাকে না। বিশেষত শপিং মল, মার্কেট ও অফিস আদালতে মেয়েদের পৃথক নামাজের ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে মার্কেটে গেলেন, সেখানে নামাজের সময় হয়ে গেলে আপনার নামাজ পড়ার জায়গা পাবেন কিন্তু আপনার স্ত্রী কী করবে? অফিস আদালতে পুরুষের নামাজের জায়গা থাকলেও নারীদের নামাজের জায়গা থাকে না। নারী কর্মচারী কর্মকর্তারা নামাজ পড়তে চাইলে কী করবে? এমন অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্য ও অবহেলার শিকার আমাদের সমাজের নারী।
বেপর্দা বেহায়া বেলেল্লা নারী বলে গালি দেন অনেক ইসলামি বক্তা। মায়ের জাতিকে এভাবে গালি দেওয়া কোরআন সুন্নাহর কোথায় আছে? রাসুল (সা.) যখন কোনো কঠোর কথা বলতেন সেটারও একটা সৌন্দর্য থাকতো, আমাদের স্কলারদের কথায় সেই সৌন্দর্য কোথায়? এমন রুক্ষভাবে গালি দিয়ে এবং অসম্মান করে কি মানুষকে ধর্মের পথে আনা যাবে? একটা মেয়ে বোরখা না পরলে যদি বেলেল্লা হয় তাহলে যেই পুরুষ তার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাকে বেহায় বেলেল্লা বলা হবে না? সব দোষ কেবল নারীর উপর? এটা সত্যি দুঃখজনক, ইউটিউবে যেসব ধর্মীয় আলোচনা ও ওয়াজ রয়েছে সেখানে এ ধরনের নানান বক্তব্য পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে অন্য বড় আলেমদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিবাদ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরা স্কলারদের কর্তব্য। সাধারণ মানুষেরও উচিত সঠিক বিষয়টি ভালো করে যাচাই করে জেনে নেওয়া। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বিষয়টি উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্য সূত্র: সময় টিভি।