২৬ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০২:৩৭:০৫ পূর্বাহ্ন


৩৪ মাসেও অসম্পন্ন সেতু নির্মাণ কাজ সময় ছিল ১৮ মাস: উধাও ছিল ঠিকাদার
কংকনা রায়, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি :
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৬-২০২৪
৩৪ মাসেও অসম্পন্ন সেতু নির্মাণ কাজ  সময় ছিল ১৮ মাস: উধাও ছিল ঠিকাদার ৩৪ মাসেও অসম্পন্ন সেতু নির্মাণ কাজ সময় ছিল ১৮ মাস: উধাও ছিল ঠিকাদার


দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার চিন্তামন-আটপুকুরহাট গ্রামীণ সড়কের জাংগাল ব্রিজ। যে ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন ১৫ গ্রামবাসী, ৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৫ সহস্রাধিক মানুষসহ শতশত ছোটবড় যানবাহনের চলাচল। ২ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ব্রিজ নির্মাণের বরাদ্দ হলে ২০২১ সালের মার্চে ভেঙে ফেলা হয় পুরোতন ব্রিজটি। এতেই দুর্ভোগ শুরু। ১ বছর ৮ মাসে পর নতুন ব্রিজ দিয়ে চলাচলের কথা থাকলেও ৩ বছর ২ মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন ব্রিজ নির্মাণ কাজ এখনো এক তৃতীয়াংশ বাকি।

ব্রিজের পার্শ্ব যে বিকল্প রাস্তা করা হয় প্রতিদিন সেই মাটির দিয়ে যাতায়াত করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ হাজার হাজার কৃষক। বৃষ্টির পানিতে কয়েক দফায় পার্শ্বরাস্তাটিও ভেসে গেলে ফের মেরামত করে যাতায়াত করেন গ্রামবাসী। তাদের এ দুর্ভোগের যেনো অন্ত নেই। তাদের আর্তনাদ শোনার যেমন কেউ নেই, তেমনি এ দুদর্শার চিত্রও দেখার কেউ নাই।

জানা যায়, ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের চিন্তামন-আটপুকুর সড়কে জাংগাল নামকস্থানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো (এলজিইডি) রংপুর বিভাগ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-২ (আর.ডি.আর.আই.আই.পি-২) এর আওতায় ২ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এপ্রোজ সড়কসহ ২৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থ, পিসি গার্ডার ব্রীজ (সেতু) নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের ৩ মার্চ দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি পান যশোরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইসিএল প্রাইভেট লি.। কাজটির মেয়াদকাল ১ বছর ৮ মাস। ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর নির্মাণকাজ শেষ করে সেতুটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বিভিন্ন টালবাহানায় কাজের মেয়াদ পেরিয়ে ১৮ মাস হতে চললেও নির্মাণ কাজের নেই কোনো অগ্রগতি। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন যন্ত্রপাতি ফেলে কয়েক দফায় লাপাত্তা হয়ে যায়। বর্তমানে পুনরায় সেতুর কাজ শুরু হলেও কাজের গতি একেবারে ধির বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

স্থানীয়রা জানান, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সেতুটি নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ১৮ মাস পার হয়েছে। এখনো এক তৃতীয়াংশ কাজ বাকি। বর্ষা এলেই বাড়ে দুর্ভোগ। বন্ধ হয়ে যায় শহরের সাথে ওই এলাকার জলশ্বেরী,কাজিহাল, চাতরাখড়ি, দওলাপাড়া, দাদুল, রুদ্রানী, মইচাঁন্দা, বাজনাপাড়া, রামেশ্বরপুর, চম্বুক, মিরপুর,পারইল, রশিদপুর, আমড়া গ্রামের যোগাযোগ। এছাড়াও ওই এলাকায় রয়েছে কাজিহাল মাদরাসা, রুদ্রানী উচ্চ বিদ্যালয় ও রুদ্রানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রুদ্রানী বাজার কলেজ, দাদুল উচ্চ বিদ্যালয় ও দাদুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফের সামনে বর্ষা মৌসুম। কাজ দ্রুত শেষ না হলে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।

এদিকে উপজেলার সর্ববৃহৎ হাট আটপুকুরহাট। সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার দুইদিন হাট বসে সেখানে। হাটে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে যা জাংগাল সেতু পারাপারই একমাত্র প্রধান ও সহজ পথ। হাটে প্রতিসপ্তাহে প্রায় ৩০ থেকে ৫০টি ট্রাক্টর, ট্রাকসহ নছিমন-করিমন ধান আনা নেয়া করে। কিন্তু নির্মাণকাজে দীর্ঘ সময় কালক্ষেপণের কারণে চরম ভোগান্তি থেকে রেহায় মিলেনি ব্যবসায়ীদেরও।

কলেজ শিক্ষার্থী সবিতা রানী, ভগিরথ রায় বলেন, ফুলবাড়ী শহরে যাতাযাতের একমাত্র পথ জাংগাল ব্রিজ। সেটি দীর্ঘদিন থেকে নির্মাণ কাজ হওয়ায় আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে খারাপ। বাধ্য হয়ে এখন আমরা শহর্রে ম্যাস ভাড়া করে থাকি। কেনোনা এই পথে যাতায়াত করতে খুবই সমস্যা হয়। সময়মতো কলেজ কিংবা প্রাইভেটে পৌঁছাতে পারিনা।

চিন্তামনের শহিদুল ইসলাম, মাদিলাহাট বাজারের লুৎফর রহমান বলেন, সেতুটির কারণে ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মালামালবাহী গাড়ী চলাচলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অন্যদিকে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে ছোট-বড় যানবাহন। বিকল্প দিক দিয়ে ঘুরে যেতে হলে প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার রাস্তা বেশি পাড়ি দিতে হয়।

ফুলবাড়ী থেকে আটপুকুরহাট সংলগ্ন দাদুল উচ্চ বিদ্যালয়ে নিত্য যাতায়াত করেন সহকারী শিক্ষক পাপিয়া চক্রবর্তী। সাথে তার দুই বছরের ছেলে সন্তান। অটোরিকশায় চেপে তাকে রোজ যেতে হয় কর্মস্থলে। তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্রিজটি ভেঙে রেখেছে ঠিকাদার। আমার সন্তান পেটে থাকাকালিনও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এই সড়কে। আমার ছেলের বয়স বর্তমানে ২ বছর তবুও ব্রিজের কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

স্বাস্থ্যকর্মী রাজিয়া সুলতানা বলেন, ব্রিজের কাজ তিনবছরেও সম্পন্ন না হওয়ায় শহরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই বাজে। গুরুত্বর কোনো রোগীকে ফুলবাড়ী নিয়ে যেতে খুব বেগ পোহাতে হয়। প্রসুতি নারীদের নিয়ে বেশি বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সড়ক যোগাযোগ ঠিকঠাক না থাকায় জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায় প্রসবের ব্যাথা উঠলে।

সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের ম্যানেজার জয়নাল আবেদিনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সেতুটি নির্মাণ করতে ২২টি পাইলিং করতে হয়েছে। সেখানে মাটির সমস্যার কারণে পাইলিং করতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম প্রধান বলেন, কাজ অনেকটাই হয়েছে। প্রথমে মাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। গাডারের কাজ হয়েছে। এখন দুই সাইডের ঢালাই, সাটারিংয়ের কাজ শুরু হবে।

তিনি আরো বলেন, আগামী ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। সামনে ১ মাসের মধ্যে ব্রিজের উপর দিয়ে লোক যাতায়াত করতে পারবেন।  

কাজিহাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মানিক রতন বলেন, এই সেতুটি তৈরি করতে ঠিকাদারিপ্রতিষ্ঠান ১ বছর ৮ মাসের কাজ ৩ বছর সময় নেয়ায় খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই সড়কে চলাচলকারীদের। বহুবার এলজিইডি অফিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারের গাফলতির কারণে এই দুর্ভোগ।

ফুলবাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) সফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রিজের কাজটি ২০১৮ সালের বাজার মূল্যের। বর্তমানে সবপ্রকার মালামালের দামবৃদ্ধি পেয়েছে তাই সমস্যা হয়েছে। বর্তমানে ব্রিজের ৬৪ ভাগ কাজ হয়েছে। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জেলা এলজিইডি সময় চেয়ে আবেদন করেছেন বলে জেনেছি। কিন্তু আমি এখনো কোনো অনুমতিপত্র হাতে পাইনি। ঠিকাদারকে তাগিদা দেয়া হয়েছে দ্রুত সময়ে কাজটি শেষ করতে।

ইউএনও মীর মো. আল কামাহ তমাল সমকালকে বলেন, খবর নিয়েছি কাজ শুরু করেছেন। বিলম্ব হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ সত্য। তবে সার্বক্ষণিক খোঁজ নিয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

দিনাজপুর নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিইডি) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ঠিকাদার বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। উপজেলায় সে আবেদনের কপি পাঠানো হয়েছে।