রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কেবল সৌন্দর্যের আঁধার নয় বরং বনজ সম্পদেও ঠাসা এক উন্মুক্ত প্রান্তর। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। সেখানে প্রায় ১৭০ প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য বনজ সম্পদ রয়েছে। লোকবল সংকট ও গার্ডেনটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হতে বসেছে বিলুপ্ত প্রায় এসব বনজ সম্পদগুলো। ফলে একদিকে যেমন গার্ডেনের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে ব্যহত হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রম।
এতে শিল্পের কাঁচামাল, ঔষধি, ফলজ, দামি কাঠ, তেলজসহ দেশি-বিদেশি প্রায় ১৭০ প্রজাতির বনজ সম্পদ রয়েছে। বাগানটিতে এতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থাকা সত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বোটানি বিভাগের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের অভাবে পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এ সম্পদ রক্ষা করা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গার্ডেনটি ১৬ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন ২৫ জনের অধিক রক্ষণাবেক্ষক। কিন্তু সেখানে রয়েছে মাত্র ২ জন কর্মচারী। দীর্ঘদিন থেকে এমন সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও বাগানটির সংস্কারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বোটানি বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বাগানটি বোটানি বিভাগের অধীনে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তেমন গুরুত্ব সহকারে দেখছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
বাগানটিতে 'বাওবা' ট্রি নামক এক ধরনের বৃক্ষ রয়েছে। যা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ততম গাছ বলে পরিচিত। এছাড়া রয়েছে ৫০০টি পাম অয়েল।
বোটানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রক্তচন্দন, আকাশমনি, অর্জুন, অশোক, বাবলা, বাদরলাঠি, বেট ঝপ, বহলা, বনকাঠাল, বোটল ব্রাশ, ছাতিম, দেবদারু, ডুমুর, ইউকেলিপটাস, গামার, গর্জন, হরিতকি, যয়তুন, চায়না জাও, কঞ্চন (লাল), রক্তকরবি, কাঁঠালচাপা, কাঠবাদাম, ককশা, খয়ের, কৃষ্ণচূড়া, মেগনোলিয়া, মেহগনি, মহুয়া, নাগেশ্বর, রাখালশষা, পান্থ-পাদব, পলাশ, রাবার, শরিফা, সর্ণাচাঁপা, সেগুন, শিশু, বেরিকেট বটের মতো নামি দামি দূর্লভ গাছ এ গার্ডেনটিতে।
এ ছাড়া আরও রয়েছে থাই কাঠগোলাপ, চাইনিজ দেবদারু, জহুরি চাঁপা, কাঠ লজ্জাবতী, শ্বেত চাঁপা, নীল চিতা, পারুল, কেশিয়া নুড়–শা, পানপরাগ, রাণীচূড়া, কৃবট, ইস্টার আপেল, মরনিং গ্লোরি, হস্তীকর্ণ, জাকারান্তা, বাসক, মাধবী লতাসহ আরো বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির প্রায় ১০০ প্রজাতির গাছ।
গবেষকরা বলছেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যা কর্মী সংকট বড় একটি সমস্যা। বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি চেষ্টা করে তাহলে সংকটগুলো দূর করে একটি মডেল গার্ডেন তৈরি করা সম্ভব।
গবেষক ও বোটানি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বোটানি বিভাগের অধীনে রয়েছে। গার্ডেনটি দেশি-বিদেশি অনেক দামি ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতিতে সমৃদ্ধ। বর্তমানে সেখানে জনবল সংকট রয়েছে। প্রাথমিক দিকে ১৬-১৮ জন মালি কাজ করলে বর্তমানে কাজ করেন মাত্র দু'জন। ফলে সঠিকভাবে পরিচর্যা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে গবেষণা কাজ চলমান রয়েছে। অনেক নতুন নতুন প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু সঠিকভাবে বাগানটি পরিচালনা করার জন্য অর্থ এবং লোকবল প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট সহযোগিতা পেলে বাগানটি রক্ষার পাশাপাশি দর্শনীয় একটি চমৎকার বাগানে পরিনত করা সম্ভব।
জানতে চাইলে বোটানি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. শহিদুল আলম বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাশোনা করার জন্য ১৬-১৮ জন দক্ষ লোকবল ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজনের খাতিরে তাদেরকে অন্যান্য জায়গায় বদলি করেছেন। এদিকে গার্ডেনের দেখাশোনা করেন মাত্র দুজন প্রবীণ মালি। ফলে সঠিকভাবে পরিচর্যা হচ্ছে না গার্ডেনটির। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট এ বিষয়ে আমার পূর্বের চেয়ারম্যান স্যারেরাও বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানিয়েছেন কিন্তু প্রশাসনের দায়িত্বশীল পরিবর্তন হলে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান প্রশাসনের নিকট এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। যদি প্রশাসন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে তবে এ সংকট থেকে উত্তরন সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনটি বোটানি বিভাগের অধীনে রয়েছে। এর সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব ওই বিভাগেরই। তবে বিশেষ প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে মৌখিক নয় বরং লিখিত অভিযোগ বা আবেদন জানালে সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে প্রশাসন। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো লিখিত আবেদন বা অভিযোগপত্র আসেনি।
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গাছের উপর গবেষণা করার সুবিধার্থে ১০৫ প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেনের। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আলী ইউনুসের হাত ধরে প্রায় ১৬ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয় এই বাগানটি। বর্তমানে বাগানটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও রয়েছে বিভাগটি।