২৬ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০২:৫২:২৭ পূর্বাহ্ন


নীল অর্থনীতির সোনালি হাতছানি
Online Desk
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১১-২০২৩
নীল অর্থনীতির সোনালি হাতছানি File Photo


বঙ্গোপসাগর উপকূলের পর্যটন নগরী কক্সবাজার অর্থনীতির নতুন কেন্দ্র হতে যাচ্ছে। রেল যোগাযোগ চালু, আধুনিক বিমানবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর ও জ্বালানি জোগানের বড় কেন্দ্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দেশের ‘নীল অর্থনীতি’র সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণও তারই অংশ।

সেই হাতছানি আজ শনিবার রেলপথ উদ্বোধনের মাধ্যমে কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ শুরু হয়ে যাবে। কক্সবাজারে আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগের এ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন। রেলসহ ১৮টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

 

এসব প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোজ্বা মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরকেও নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, যা হবে আন্তর্জাতিক সংযুক্তির অন্যতম বড় কেন্দ্র। চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। মহেশখালীতে গড়ে উঠছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি প্ল্যান্ট, সৌরবিদ্যুৎসহ সবুজ এনার্জি হাব। টেকনাফের সাবরাংয়ে চালু হয়েছে ট্যুরিজম পার্ক। সব মিলিয়ে অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্রস্থল হতে যাচ্ছে কক্সবাজার।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বেল্টকে ধরে শিল্পায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা সবার আগে উপস্থাপন করে জাপান। বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি) ইনিশিয়েটিভ, যা বিগ-বি নামে পরিচিত। এই বিগ-বির আওতায় মূলত মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজারের উন্নয়নের প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়।’

২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী বিগ-বি উদ্যোগটি শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করেন। বৈশ্বিক অর্থনীতির আলোকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বেল্ট খুব সম্ভাবনায় বলে উল্লেখ করা হয়। বিগ-বি মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটি হলোজ্বা শিল্প ও বাণিজ্য। মূলত গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করেই এ স্তম্ভ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক হাব হওয়া যাবে। দ্বিতীয়টি হলোজ্বা জ্বালানি, যা মাতারবাড়ী প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখানে কয়লা বিদ্যুৎ, এলএনজি ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হয়। এখান থেকেই জ্বালানি যাবে সারা দেশে। আর তৃতীয়টি হলোজ্বা পরিবহনব্যবস্থা। দেশের বৃহত্তর শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পরিবহনব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে, কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ এবং কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ সবই এই বিগ-বিকে কেন্দ্র করে।

এ বিষয়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘মূলত বিগ-বি ইনিশিয়েটিভ থেকেই মহেশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথমে বিনিয়োগের পর গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য বিনিয়োগ করে জাপান। আর এ অঞ্চলই হতে যাচ্ছে আগামীর অর্থনীতির হাব।’

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সংশোধিত আকারে একনেকে ১৮ হাজার ৩৪ কোটিতে গিয়ে পৌঁছে। কক্সবাজারের ঘুনদুম পর্যন্ত তা নির্মাণের কথা থাকলেও মিয়ানমারের আপত্তির কারণে ঘুনদুম পর্যন্ত না গিয়ে রামু থেকে সরাসরি কক্সবাজারে চলে যায় রেললাইন। এতে এর বাজেট কমে ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটিতে গিয়ে ঠেকে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চালানোর সব ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে।

এ রেললাইন কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনের সময় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মাস্টারপ্ল্যান। এই মাস্টারপ্ল্যানের আলোকেই পর্যটন শিল্পের বিকাশে এবং স্থানীয় অর্থনীতির সম্প্রসারণে এ রেললাইন।’

শুধু রেললাইনই নয়, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পেরও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের সঙ্গে রয়েছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। ১৭ হাজার কোটি টাকায় মাতারবাড়ী বন্দরের জন্য টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন শেষে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, মাতারবাড়ীসহ পুরো কক্সবাজারের উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। আধুনিক বিমানবন্দর, সাবরাংয়ে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করেই। অর্থনীতির চিত্র বদলে দেবে এসব প্রকল্প।

উদ্বোধন করা হবে যেসব প্রকল্প : কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬টি প্রকল্পের খরচ ৫৩ হাজার ৪৬৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এই ১৬ প্রকল্পের বাইরে রয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প যার বাজেট ১৫ হাজার ৪৩৪ কোটি এবং মাতারবাড়ী বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণে বাজেট ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এসব প্রকল্পে খরচ হচ্ছে ৮৬ হাজার ৭০৯ কোটি ৬ লাখ টাকা।

আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের পর তিনি মহেশখালীর মাতাবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। একই স্থানে তিনি মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৫৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন কক্সবাজার বিমানবন্দরে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাঁকখালী নদীর ওপর বক্স গার্ডার ব্রিজ উদ্বোধন করবেন।

অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ঠান্ডা চৌকিদারপাড়া আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, চকরিয়া পৌরসভা বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ প্রকল্প, ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪-এ বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ডিজাইন ও স্থাপনকরণ প্রকল্প, কক্সবাজার সদর উপজেলা জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প, মহেশখালীতে ইউনুসখালী নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ, উখিয়ায় রত্না পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ, মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়) (তৃতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় ভূমি ভরাটসহ বিভিন্ন প্রকল্প।