প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও ১২শ’ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করবেন
সাত বছর আগে কক্সবাজার উপকূলে জাপানের অর্থায়নে শুরু হয়েছিল সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। শেষ হয়েছে নির্মাণ কাজ। এবার অপেক্ষা উদ্বোধনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করবেন এই কেন্দ্রের। ১২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগামী ১১ নভেম্বর উদ্বোধন করবেন তিনি। একইসঙ্গে উদ্বোধন করবেন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দরেরও। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এক হাজার ৩১ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা এই বন্দরটি উদ্বোধন হলে পাল্টে যাবে পুরো দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব হিসেবে গড়ে উঠছে এই মহেশখালী।
একনজরে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ॥ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, বঙ্গোপসাগর মালাক্কা প্রণালী হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই দক্ষিণ চীন সাগরের বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশসমূহ বিশেষ করে চীন ও জাপানের জন্যও বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব সর্বোচ্চ। আর বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের অবস্থান। জাপান ‘বিগ বি’ (বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ-বেল্ট) নিয়ে যে বিশাল অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চিহ্নিত করেছে তা বঙ্গোপসাগরকে আবর্তিত করেই গড়ে উঠবে। জাপানের ‘বিগ বি’ এর অংশ হিসেবে মহেশখালীতে মাতারবাড়ি এলাকায় নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর, বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, কোল জেটি এবং এলএনজি টার্মিনাল।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় গড়ে উঠবে এই গভীর সমুদ্র বন্দর। এখনো বন্দর হিসেবে গড়ে না উঠলেও গত সাত মাসে প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভিড়েছে বিশাল আকৃতির ১০টি জাহাজ।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে আট হাজার ৯৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বন্দর নির্মাণে জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ঋণ সহায়তা দিবে ছয় হাজার ৭৪২ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। বাকি দুই হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এ ছাড়া বন্দর এলাকায় সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণে জাইকা ঋণ সহায়তা দেবে ছয় হাজার ১৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাকি দুই হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সড়ক ও জনপথ (সওজ)’র ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। বন্দর ও সড়ক নির্মাণে জাপান সরকার মোট ঋণ সহায়তা দেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাহাজগুলো এখানে ভিড়বে। এরই মধ্যে ৮০ হাজার টনের একটি জাহাজ কয়লা নিয়ে এখানে বন্দরে ভিড়েছে। এরপর এক লাখ টনের জাহাজও এখানে আসবে। সেই লক্ষ্যে গভীর সমুদ্র বন্দরে প্রথম যে টার্মিনালটি চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষ থেকে হচ্ছে, সে ব্যাপারে একটি টেন্ডার করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে সরাসরি মালামাল এখানে আসবে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাবে।
এ বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। এখনকার স্মার্ট দেশ সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে। মাতারবাড়ি বন্দর বাণিজ্যিক হাব হবে। চট্টগ্রাম বন্দর হবে অর্থনীতির লাইফ লাইন। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়াও অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তরপার্শ্বে দুই হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পার্শ্বে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জেটি ও ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ এবং কন্টেনার ইয়ার্ডসহ তিনটি প্যাকেজে বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ॥ একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ইতোমধ্যে জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। উদ্বোধনের পর দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সব কাজ গুছিয়ে এখন তারা অপেক্ষা করছেন উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণের। ২০১৪ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে এ কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটির ঋণচুক্তি হয়। একই বছরের ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হচ্ছে ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ১৮.৫ মিটার গভীরতার দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। ৫১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা জাইকা দেয়। বাকি সাত হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএলের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এর জেটি ও ভৌত অবকাঠামোর ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সার্বিক ভৌত অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে ৯৫ শতাংশ।
প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করবেন। বর্তমানে আমরা প্রথম ইউনিটের ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দিচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম ইউনিটে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে গত ২৯ জুলাই। সফলভাবে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রথম ইউনিটে একসঙ্গে ৬১৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করা হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিতেও আগুন দেওয়া হয়েছে গত ২২ সেপ্টেম্বর। ওই ইউনিট থেকে এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়নি।
কেন আলাদা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ নানা দিক দিয়ে অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এগিয়ে থাকছে কেন্দ্রটি। পুরো মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দৈনিক ১৩ হাজার ১০৪ টন কয়লার প্রয়োজন হবে। এজন্য কয়লা খালাসের জেটি ও সাইলো নির্মাণ করা হয়েছে। বিশাল আকৃতির সাইলোগুলোতে ৬০ দিনের কয়লা মজুত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কয়লার জেটিতে সরাসরি ৮০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন মাদার ভেসেল ভিড়তে পারবে। আর মাদার ভেসেল থেকে কয়লা খালাস করতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুদিন। কয়লার সহজ পরিবহনের বিষয়টি মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বিশেষভাবে এগিয়ে রাখবে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, পায়রা কিংবা রামপালে মাদার ভেসেল গভীর সমুদ্রে রেখে লাইটারেজে করে কয়লা খালাস করতে হয়।
বিষয়টি একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি ব্যয়বহুল। লাইটারেজ ভাড়া ছাড়াও মাদার ভেসেলের অপেক্ষমাণ চার্জ হাজার হাজার ডলার গুনতে হয়। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এসব ঝামেলার বালাই থাকছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব জেটিতে মাদার ভেসেল ভেড়ানোর জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা ও প্রস্থে ৩০০ মিটার চ্যানেল খনন করা হয়েছে। নাব্যতা নিশ্চিত করার জন্য সেডিমেন্টেশন মিটিগেশন ডাইক করা হয়েছে। এতে করে বছর বছর ড্রেজিংয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে চ্যানেলটি। এই কেন্দ্রটির পরীক্ষামূলক উৎপাদনের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার সম্মতি দিয়েছেন। আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তিনি বলেন, সাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে তোলা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যাতে সাইক্লোন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের কবলে না পড়ে সেজন্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ মিটার উঁচু বাঁধের নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঁধের ভেতরে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো থাকছে ১০ মিটার উচ্চতায়। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সর্বোচ্চ উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসকে মাথায় রেখে এর ডিজাইন করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৭ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। বাঁধের উচ্চতা থাকছে তার দ্বিগুণ পরিমাণে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় ॥ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাপানের সহায়তার মোট প্রায় ৫১ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এবং এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অন্যতম।
পুরো প্ল্যান্টে প্রতিদিন ১০ হাজার টন ও প্রতিটি ইউনিটে পাঁচ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নে এক হাজার ৬০৮ একর জমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা ৪৩,৯২১ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ৭,৯৩৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল-এর নিজস্ব তহবিল থেকে প্রদান করা হচ্ছে।
বন্দর উদ্বোধনের মাধ্যমে সাড়ে ১৮ মিটারের গভীর চ্যানেলে নোঙর করা যাবে ॥ এই বন্দরটি উদ্বোধনের মাধ্যমে সাড়ে ১৮ মিটারের গভীর চ্যানেলে ফিডার ভেসেল নোঙর করতে পারবে। এতে পণ্য পরিবহনে বাঁচবে অর্থ ও সময়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে আট হাজার ২০০ টিইইউএস সক্ষমতাসম্পন্ন কনটেনার বহনকারী জাহাজ নোঙর করতে পারবে। ফলে পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার বন্দরে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে মাত্র ২৩ দিনেই সরাসরি নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। এই স্বপ্ন এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। যা বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আরেকটি মাইলফলক বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন। যা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আগামী শনিবার দুপুর আড়াইটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরেজমিনে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দেশের প্রথম এই গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করবেন। ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে। এখানে বড় ধরনের ফিডার ভেসেল আসবে। অর্থ ও সময় বাঁচবে। অর্থনীতিতে সুপ্রভাব ফেলবে।
চট্টগ্রাম থেকে ৩৪ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর বন্দর ॥ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ি দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। জাহাজে যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি ধলঘাট পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সড়ক ও বন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক তিন মিটার দীর্ঘ।
সাগর থেকে উপকূল পর্যন্ত পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাঁধ। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় চ্যানেলের পানি পুরো নীল। দেশের আর কোনো বন্দরে এমন নীল পানি নেই। নীল পানি থাকা মানে নৌপথের বড় অংশে পলি জমার আশঙ্কা কম। ইতোমধ্যে বন্দরের নিরাপত্তায় উত্তর ও দক্ষিণদিকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রের ঢেউ প্রতিরোধ বাঁধ। প্রকল্পের বিশদ নকশা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জেটি নির্মাণ, জাহাজ হ্যান্ডেলিং সরঞ্জাম সংগ্রহ ও টাগ বোট ক্রয়সহ তিনটি প্যাকেজে ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হবে। সকল প্রস্তুতি শেষে আগামী শনিবার প্রকল্পের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সহজেই আসতে পারবে বৃহদাকার কনটেনার ॥ এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে সাধারণত মাত্র ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটবিশিষ্ট জাহাজ বার্থ করতে পারে। তবে সম্প্রতি ১০ মিটার ড্রাফটের একটি জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব জাহাজ ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৪০০ টিইইউএস কনটেনার বহন করতে পারে। একটি মাদার ভেসেলের ধারণক্ষমতা ৮০০০ থেকে ১০ হাজার টিইইউএস কনটেনার। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে আট হাজার টিইইউএসের বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন কনটেনার বহনকারী জাহাজ নোঙর করতে পারবে। সহজেই আসতে পারবে বৃহদাকার কনটেনার জাহাজ।’
অর্থনীতিতে ভূমিকা ॥ মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে অন্যান্য বন্দর থেকে এর দূরত্ব বেশি হবে না। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল, পায়রা বন্দর থেকে মাতারবাড়ির দূরত্ব ১৯০ নটিক্যাল মাইল ও মংলা বন্দর থেকে গভীর সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ২৪০ নটিক্যাল মাইল। তাই মাতারবাড়িতে মাদার ভেসেল (বৃহদাকার কনটেনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাস করে অল্প সময়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে। পুরোদমে মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরিসংখ্যান বলছে, গভীর সমুদ্র বন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বন্দরের জন্য নির্মাণ হচ্ছে ২৭ কিলোমিটার সড়ক ॥ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে সড়কপথে যাতায়াত সহজ করার জন্য কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাসিয়াখালি থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ২৭ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে মাতারবাড়ি বন্দর থেকে ধলঘাট গোলচত্বর পর্যন্ত সোয়া এক কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হবে। এ ছাড়া ধলঘাট থেকে ফাসিয়াখালী পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের জন্য ২ লেনের ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। যা ভবিষ্যতে চার লেনের মহাসড়কে উন্নীত করা হবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)’র কর্মকর্তারা জানান।
প্রকল্প সূত্র জানায়, সড়ক নির্মাণের তিনটি প্যাকেজের মধ্যে বন্দরের উত্তর-দক্ষিণে সংযোগের জন্য এক দশমিক ১৫ কিলোমিটার চার লেনের সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে সিডাব্লিউ-৩এ প্যাকেজে। এই প্যাকেজের আওতায় আরও প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে চারটি সেতু, দুটি গোলচত্বর ও একটি রেলওভারপাস নির্মাণ করা হবে। প্যাকেজ সিডাব্লিউ-৩বি’র আওতায় ৬ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক, চারটি সেতু ও একটি রেলওভার পাস নির্মাণ করা হবে। প্যাকেজ সিডাব্লিউ-৩সি’র আওতায় ৯ দশমিক ১২ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক, ছয় সেতু ও একটি রেলওভার পাস নির্মাণ করা হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।