প্রকল্প অনুমোদনের ছয় বছর পর দৃশ্যমান হচ্ছে আরেক উড়াল মহাসড়ক ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। নকশা অনুযায়ী বেশ কিছু জায়গায় নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। আশুলিয়া অংশে মাটির ওপর দৃশ্যমান হচ্ছে খুঁটি। প্রকল্প এলাকাকে তিন ভাগে ভাগ করে কাজ চলছে।
জমি অধিগ্রহণ, ঋণের টাকা না পাওয়া, ইউটিলিটি অপসারণসহ নানা জটিলতায় আটকে ছিল এটির নির্মাণকাজ।
সাভারের ইপিজেড থেকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা পর্যন্ত নির্মিত হবে এই উড়াল মহাসড়ক। এটি যুক্ত হবে বিদ্যমান নির্মীয়মাণ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে আশুলিয়ার পথ যুক্ত হলে সাভারের ইপিজেড থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এক রেখায় পাড়ি দেওয়া যাবে ৪৪ কিলোমিটার সড়ক।
ওঠানামার পথসহ (র্যাম্প) এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় ৮২ কিলোমিটার।
প্রকল্পের নথি বলছে, ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল মহাসড়কের মূল সড়কের দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। সঙ্গে র্যাম্প থাকছে ১০.৮৩ কিলোমিটার। এর সঙ্গে যুক্ত হবে নবীনগরে ১.৯৫ কিলোমিটার উড়ালপথ আর ২.৭২ কিলোমিটার সেতু।
প্রকল্প এলাকায় নতুন করে নির্মাণ করা হবে আরো ১৪.২৮ কিলোমিটার সড়ক। ড্রেনেজ এবং ডাক্ট থাকবে ১৮ কিলোমিটার।
ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চল সাভার, আশুলিয়া, নবীনগর ও ইপিজেডসংলগ্ন শিল্প এলাকার যানজট নিরসন এবং যোগাযোগব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন করতে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালপথ নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২০টি এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় পাঁচ-ছয়টি জেলার মানুষ আশুলিয়া-নবীনগর-বাইপাইল হয়ে সহজে ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টি জেলার আনুমানিক চার কোটি মানুষ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে লাভবান হবে।
গত বৃহস্পতিবার প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উত্তরার আবদুল্লাপুর থেকে আশুলিয়ামুখী সড়কের শুরুতে বড় একটি খুঁটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই খুঁটিকে মজবুত করতে মাটির নিচে ৯টি পিয়ারের ওপর ভিত তৈরি করা হয়েছে। অথচ পদ্মা সেতুর একটি খুঁটিতে সর্বোচ্চ সাতটি পিয়ার ছিল। বিশাল শক্ত এই খুঁটির উচ্চতা হবে ৪০ মিটার। আশুলিয়ার চার লেনের সড়কের ওপর যে উড়ালপথটি নির্মাণ করা হবে, এর পুরোটাই এই এক খুঁটির ওপর ভর করে ঢাকামুখী প্রবেশ করবে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখানোর সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি কম্পানির পরিচালন ও অবকাঠামো বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক গু ফেং কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজ শুরুর আগেই নানা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। বিদ্যুতের প্রচুর তার রয়েছে সড়কে। চাইলেই এগুলো দ্রুত অপসারণ করা যাচ্ছে না। এই অঞ্চলে শিল্প-কারখানা অনেক বেশি। তাই দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে কাজ করা যায় না।
গু ফেং বলেন, প্রকল্পের জমি বুঝে পাওয়াও আরেক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করছে। নিচের সড়ক খুব আঁকাবাঁকা। কিন্তু উড়ালপথ সোজা হতে হবে। তাই নিচের সড়কও সোজা করা গুরুত্বপূর্ণ। মাটির নিচে ইউটিলিটি লাইন অপসারণ করা আরেক চ্যালেঞ্জ। কোনো কিছুই গোছানো না। আবার মূল পথের কাজ শুরু করার আগে বাইপাস (গাড়ি চলাচলের বিকল্প পথ) সড়ক তৈরি করে দিতে হচ্ছে। যেন ট্রাফিক ব্যবস্থা ঠিক থাকে। যান চলাচল খুব বেশি ব্যাহত না হয়।
আশুলিয়া থেকে মাদবরবাড়িমুখী তুরাগ নদের তীর ধরে এগোতে থাকলে দেখা যায়, দুই ধারে স্প্যান বসাতে খুঁটি নির্মাণের কাজ চলছে। মূলত এই সড়কেই প্রথম খুঁটির কাজ শুরু হয়। দৃশ্যমান কাজের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি এখানেই।
প্রকল্পের পরিকল্পনা মতে, এই আড়াই কিলোমিটার সড়কের অস্তিত্ব পরে আর থাকবে না। এই অংশে পুরোটাই থাকবে উড়ালপথ। নিচের বিদ্যমান সড়কটি ভেঙে তুরাগ নদের প্রবাহকে করা হবে আরো গতিশীল। এই অংশে বড় সেতু করা হবে দুটি। একটি এক্সপ্রেসওয়ের সড়কের জন্য, আরেকটি সাধারণ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ টোলসহ এবং টোলমুক্ত দুই ধরনের পথই উন্মুক্ত থাকছে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে পণ্য পরিবহনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এখন দিনে ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে পারে না। এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ শেষে ঢাকার ওপর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ট্রাক চলাচল করতে পারবে। নিচের সড়কেও এর কোনো প্রভাব পড়বে না। যানজটে আটকে থাকতে হবে না। আন্ত জেলা যোগাযোগে ব্যাপক উন্নতি হবে।
মনজুর হোসেন বলেন, দুটি উড়ালপথ যখন যুক্ত হবে, তখন ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে কোনো গাড়িকে আর শহরে থামতে হবে না। ঢাকার ভেতর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে উড়ালপথে ওঠানামার জন্য র্যাম্প থাকছে। ফলে যেকোনো জায়গা থেকে এর সুবিধা নেওয়া যাবে।
প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ৯ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা ঋণ দেবে। বাকি অর্থের জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায়। ঋণের টাকা সময়মতো না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হচ্ছে না।
প্রকল্প পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, এখন কাজের গতি ভালো। মূলত গত জানুয়ারি থেকে এরই মধ্যে ৯.৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে ২৫ শতাংশ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সমীক্ষায় প্রকল্পের প্রভাবের আলোচনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালপথ প্রকল্পটি সাভার, আশুলিয়া, নবীনগর ও ইপিজেডসংলগ্ন এলাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরো পথের নির্মাণ শেষ হলে ঢাকার ভেতর বড় গাড়ির চাপ কমবে। খুব দরকার না হলে আন্ত জেলার বাসগুলো ঢাকার সড়কে নামতে হবে না। পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগত একটি নতুন করিডরের সূচনা হবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে যুক্ত হবে।