হামাসের সামরিক শাখা ইজ় আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের প্রধান মহম্মদ দেইফের পরিকল্পনাতেই ৭ অক্টোবর ইহুদিদের পবিত্র দিবস সিমহাত টোরায় গাজ়া ভূখণ্ড থেকে নজিরবিহীন হামলার শিকার হতে হয়েছে ইজ়রায়েলকে। এই সফল ত্রিমুখী হামলার নেপথ্যে ছিল দু’বছরের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন এবং পরিকল্পনা।
বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে এসেছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হামাস যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের একটি ভিডিয়ো। যেখানে ঝটিকা হামলায় একটি বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে ‘শক্র শিবিরের’ মানুষদের পণবন্দি করার কৌশল রপ্ত করতে দেখা গিয়েছে অ্যাসল্ট রাইফেল এবং রকেট লঞ্চারে সজ্জিত হামাস বাহিনীকে।
গাজ়া সীমান্তে ইজ়রায়েল নির্মিত ‘দি গ্রেট স্মার্ট ফেন্স’-এর একটি সামরিক ঘাঁটির আদলে তৈরি ওই বাড়িটিতে হামলার অনুশীলন চালানো হয়েছিল বলে হামাস প্রকাশিত ভিডিয়োটিতে জানানো হয়েছে। আল-কাসাম ব্রিগেডের ‘এলিট’ কমান্ডো বাহিনী আল-নুখবার যোদ্ধারা অংশ নিয়েছিলেন এই প্রশিক্ষণে।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর দাবি, গাজ়া-ইজ়রায়েল সীমান্তবর্তী অ্যারেজ ক্রসিং থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে প্রায় দু’বছর ধরে চলেছিল হামাস কমান্ডোদের এই অনুশীলন পর্ব। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তা টের পায়নি ইজ়রায়েলের বিশ্বখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ!
সিএনএন প্রকাশিত ওই খবরে দাবি, ইজ়রায়েল সীমান্ত লাগোয়া গাজ়া ভূখণ্ডের মোট ছ’টি প্রশিক্ষণ শিবিরে হামলার অনুশীলন চালিয়েছিলেন হামাসের যোদ্ধারা। বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল ইজ়রায়েল ফৌজের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘাত এড়িয়ে যত বেশি সম্ভব পণবন্দি ধরে আনার উপর।
এই ছ’টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে একটির অবস্থান ছিল সীমান্তের মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে। একটি মধ্য গাজায়। অন্য তিনটি সীমান্ত থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণ গাজ়ায়। দক্ষিণ গাজ়ায় একটি শিবিরে সমুদ্রপথে হামলারও মহড়া দিয়েছিল হামাসের নৌযোদ্ধারা। তাদের লক্ষ্য ছিল শত্রু ভূখণ্ডে সৈকত শহরগুলি।
হামাস প্রকাশিত আর একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, তাদের যোদ্ধাদের প্যারাগ্লাইডিং উড়ান এবং অবতরণ অনুশীলন। ইজ়রায়েল ফৌজের বানানো ‘স্মার্ট ফেন্স’ এড়িয়ে হামলা চালানোর জন্য গত ৭ অক্টোবর হামাসের একটি বাহিনী প্যারাগ্লাইডারেরও সাহায্য নিয়েছিল।
ইজ়রায়েলি সেনার হামলার বিধ্বস্ত গাজ়ায় আল-কাসাম ব্রিগেডের একটি সীমান্তবর্তী ডেরা থেকে উদ্ধার করা কিছু নথিপত্র আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হাতে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে আরবি ভাষায় লেখা চলতি বছরের ১৫ জুন তারিখের ১৪ পাতার একটি ‘টপ সিক্রেট’ নথি।
ওই নথির মানচিত্রে গাজ়া সীমান্তবর্তী কিবুট্জ় শহরের সম্ভাব্য হামলাস্থলগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। রয়েছে পণবন্দিদের তুলে আনার পথনির্দেশিকা। যা দেখে ইজ়রায়েলের প্রাক্তন গোয়েন্দা আধিকারিক মাইকেল মিলস্টাইন জানিয়েছেন, অতীতে কোনও প্যালেস্তেনীয় গোষ্ঠীর এমন নিপুণ ছক তিনি দেখেননি।
১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র দিন ইয়ম কিপুর দিনে অতর্কিত হানায় ইজ়রায়েলকে বিপাকে ফেলেছিল আরব দেশগুলির জোট। অর্ধ শতক পরের অতর্কিত হামলায় ইহুদি জনগোষ্ঠীর মনে সেই ভয়াবহ স্মৃতিই ফিরিয়ে এনেছেন আল-কাসাম কমান্ডার দেইফ। ঘটনাচক্রে, যিনি এক জন প্রতিবন্ধী।
২০২১ সালের মে মাসে ১৫ দিনের ইজ়রায়েলি হামলায় তিনশো প্যালেস্তিনীয়ের মৃত্যুর পরেই প্রত্যাঘাতের পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিলেন দেইফ। তাঁর সহযোগী ছিলেন, গাজ়ায় হামাসের প্রধান নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং হামাসের বিদেশ সংক্রান্ত শাখার ভারপ্রাপ্ত নেতা আলি বারাকা-সহ হাতেগোনা কয়েক জন।
বারাকা বুধবার রয়টার্সকে বলেন, ‘‘দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।’’ ইজ়রায়েলি সেনার একটি সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে দাবি, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের গোড়া পর্যন্ত, অর্থাৎ দু’বছরেও বেশি সময় ধরে চলেছিল হামলার প্রশিক্ষণ।
ছ’টি শিবিরের উপগ্রহচিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে, কয়েক মাস আগেই সেখানে যাবতীয় তৎপরতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, সফল প্রশিক্ষণের পর হামলার প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, অন্যান্য উপকরণ এবং পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত করতে সক্রিয় ছিল হামাস। এই পর্বেও ছিল চূড়ান্ত গোপনীয়তা।
ইজ়রায়েল সেনার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ‘স্মার্ট ফেন্স’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা লঙ্ঘনের কোনও চেষ্টা হলেই তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু সেই মাটির গভীরে সুড়ঙ্গ প্রতিরোধী কংক্রিটের ভিত এবং মাটির উপরে ইস্পাতের ২০ ফুট উঁচু ঘেরাটোপের এই প্রতিরক্ষা দেওয়াল হেলায় ভেদ করেছে হামাস।
কয়েকশো সিসি ক্যামেরা, সেন্সর, রাডার, নজরমিনার-যুক্ত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই দেওয়ালের ২৮টিরও বেশি পয়েন্ট দিয়ে সে দিন অনুপ্রবেশ করেছিল হামাস। তার আগে রকেট এবং ড্রোন হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ৫০০ মিটার ব্যবধানে বসানো নজর মিনারগুলির বেশ কয়েকটিকে।
হামাস কমান্ডোদের নিশানায় ছিল গাজ়ার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লাগোয়া নজরমিনারগুলি। উদ্দেশ্যে ছিল, আমজনতার মধ্যে মিশে থেকে হঠাৎ হামলা চালানো। এ ধরনের আকস্মিক, দ্রুত গতির এবং বহুমুখী পরিসরের হামলায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল ইজ়রায়েল সেনা। কার্যত কোনও প্রতিরোধ করতে পারেনি তারা।
হামলা চালানোর আগে সীমানা প্রাচীর ভাঙতে বুলডোজার ব্যবহার করে হামাস। তার পর প্রাচীরের ভাঙা অংশ দিয়ে মোটরবাইক এবং মেশিনগানবাহী গাড়ি নিয়ে অনুপ্রবেশ করে ইজ়রায়েলি ভূখণ্ডে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যানবাহন এবং বুলডোজ়ার লুকিয়ে রাখতে সুবিধা হয়েছিল তাদের।
হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে একটি অংশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল অসামরিক মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো এবং পণবন্দি বানানোর জন্য। অন্য একটি অংশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সীমান্তবর্তী নজরমিনার এবং ঘাঁটিগুলির উপর হামলা চালিয়ে মোতায়েন সেনাদের ব্যস্ত রাখার।
ইজ়রায়েল সেনার মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাস অবশ্য সেনা বা গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের গাফিলতির কথা স্বীকার করেননি। তিনি জানিয়েছেন, নিয়মিত ভাবেই গাজ়া ভূখণ্ডে হামাসের ডেরায় যুদ্ধবিমান এবং সাঁজোয়া কপ্টারের হানাদারি চলে। ধ্বংস করা হয় প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিও।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে গাজ়া জুড়ে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের ‘জাল’ বানিয়ে ফেলেছে হামাস। তাদের নেতা এবং যোদ্ধাদের পাশাপাশি অস্ত্র এবং সরঞ্জামও থাকে ওই সুড়ঙ্গগুলিতে। বিমানহানায় সেই ‘নেটওয়ার্ক’ ভাঙা সম্ভব হয়নি ইজরায়েল সেনার পক্ষে।