জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগদানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রে আগমনকে কেন্দ্র করে এবং যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে দলের অভ্যন্তরে চলছে পাইকারি হারে চাঁদাবাজি। দলের প্রবাসী সাধারন কর্মীদের বিভিন্ন পদ দেবার নাম করে তাদেরকে ফাঁদে ফেলে নগদ অর্থের লেনদেন এখন ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধেও সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) ও তার যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত প্রতিনিধির মাধ্যমে পাইকারি হারে চাঁদাবাজির খবর দলের তৃণমুলের কর্মীসহ উচ্চ পর্যায়ের নেতারা জানলেও কেউ তার বিরুদ্ধে 'টু শব্দ করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বহু বাড়ির মালিক যা নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিউ ইয়র্ক ছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসি ও ফ্লোরিডাতেও বেনামে তার অনেকগুলো বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী নাম ভাঙ্গিয়ে তিনি এমন কোন জায়গা নেই যে তিনি চাঁদাবাজি করেননি। আগামী নির্বাচনে তার ফান্ডের দরকার বলে দলের প্রবাসী কর্মীদের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার চাঁদা নিচ্ছেন। নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা তার এই চাঁদাবাজির মূল এজেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছেন। এছাড়াও আরো অনেক সাব এজেন্ট রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা সংগ্রহ করছেন চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা বলেছেন আমরা গোলাপের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। গোলাপ বাংলাদেশের যেভাবে চাঁদাবাজি করছেন ঠিক তেমনিভাবে প্রবাসেও দলের নিরীহ নেতা কর্মীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করছেন যা দীর্ঘদিন ধরে দল এবং প্রধানমন্ত্রীর সুনামকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে।
আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) সাম্প্রতি অর্থ পাচার সংক্রান্ত মামলায় ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগ নেতা ও নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসিন্দা নির্মাণ ব্যবসায়ী আবুল কাশেম ওরফে একাশি কাশেমের সাথে যোগসাজস করে ব্রুকলিনের জনৈক আওয়ামী লীগ কর্মীকে যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে তার কাছে থেকে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উক্ত অর্থ তারা দু'জনে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি ক্রয়ের দেশের বাইরে এমন সম্পদ তাঁর রয়েছে বলে নির্বাচনী হলফনামায়ও উল্লেখ করেননি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি চলতি সালের ১৩ জানুয়ারি শুক্রবার তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদনে আব্দুস সোবহান গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি ক্রয় করা নিয়ে সংবাদ করেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউ ইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউ ইয়র্কে একে একে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।
আব্দুস সোবহান গোলাপ একসময় নিউ ইয়র্ক প্রবাসী ছিলেন। এখানে আরও দুই দশ জন খেটে খাওয়া প্রবাসীর মতো তিনিও নানা অড জব করেছেন। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজের কাছে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। প্রতিবছরই তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে নিউ ইয়র্ক আসেন। দলীয় সভা সমিতিতে বক্তৃতা করেন।
মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সস্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। এর আগের কমিটিতে তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
ওসিসিআরপির করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কিনেছিলেন আবদুস সোবহান। সে সময় ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া আশপাশের ভবনগুলোতে ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন তিনি। নিউ ইয়র্কে কেনা এসব সম্পত্তির নথিপত্র বলছে, সম্পত্তিগুলো নগদ অর্থে কেনা হয়েছিল। এগুলোর মালিকানায় রয়েছেন তাঁর স্ত্রী গুলশান আরাও।
ওসিসিআরপির করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আবদুস সোবহান নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি (বাড়ি) কিনেছিলেন। ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। এর সাত মাস আগে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।