চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সম্প্রতি বন্যায় নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের ৩০০-৪০০ মিটার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রেল লাইনের বিভিন্ন স্থানে পাথর, ইটের খোয়া ও মাটি ধসে গেছে। ফলে রেলপথের ৮-১০টি স্থানে লাইন দেবে গেছে। এছাড়া সাতকানিয়ার ত্রিমোহিনী এলাকায় রেলপথে মাত্র দুটি কালভার্ট। যা পর্যাপ্ত নয়। তাই ভবিষ্যতে বন্যার ঝুঁকিমুক্ত রাখতে রেলপথ এলাকায় ২০ মিটারের আরও তিনটি কালভার্ট নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এছাড়া আগামী অক্টোবরের মধ্যে রেলপথটি উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করতে প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিয়েছেন রেলপথ সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর।
এ বিষয়ে রেলসচিব জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে ছবি দেখে মনে করেছিলাম রেললাইন বেঁকে গেছে। তাই সরেজমিন দেখতে গত শুক্রবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। যতটুকু দেখেছি তাতে কোথাও রেললাইন বেঁকে যায়নি। বন্যার পানির কারণে কিছু অংশের পাথর সরে গেছে। কিছু অংশে লাইন সামান্য দেবে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। কাছে গেলে বোঝা যাচ্ছে আসলে বাঁকা হয়নি। এটা ঢাকায় বসে বোঝানো যাবে না। সরেজমিনে দেখলে সহজে বোঝা যেত। তবে প্রকল্প এলাকায় দুটি কালভার্ট ছিল যা পর্যাপ্ত নয়। তাই এখানে আরও তিনটি কালভার্ট নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্যার পানির চাপে সাতকানিয়ার ত্রিমোহিনী এলাকায় রেলপথে ৩০০ মিটার এলাকায় ৮-১০টি স্থানে রেললাইনের পাথর ও ইটের খোয়া সরে গেছে। এটা ঠিক করতে বেশি সময় লাগবে না। তবে কালভার্টগুলো নির্মাণে কিছুটা সময় লাগবে এজন্য অক্টোবরের মধ্যে রেললাইন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দৈনিক জনকণ্ঠে ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন পরিকল্পনায় গলদ’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপর গত শুক্রবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর ও রেলওয়ে মহাপরিচালক কামরুল আহসানসহ অন্য কর্মকর্তা দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ সময় সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যায় রেললাইনের তেমন ক্ষতি হয়নি। পানির কারণে স্লিপারের নিচ থেকে পাথর সরে গেছে। কয়েক জায়গায় সামান্য কিছুটা দেবে গেছে। কিন্তু রেললাইন বেঁকে যায়নি। রেললাইনের মাত্র ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির কারণে স্লিপারের নিচ থেকে পাথর সরে গেছে। কয়েক জায়গায় সামান্য কিছুটা দেবে গেছে।’
এটি পুরো দেশের মানুষের কাছে স্বপ্নের প্রকল্প উল্লেখ করে রেল সচিব বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে রেল চলাচল শুরু হবে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এ রেললাইনের উদ্বোধন হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের যেন ভোগান্তি না হয় সেটা নিশ্চিত করতে চান। রেল যখন কোনো প্রকল্প হাতে নেয় তখন সেখানকার বিগত ১০০ বছরের নদীর গতিপথ, জোয়ার-ভাটা, জীববৈচিত্র্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা- সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়।’
ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এ রেললাইন প্রকল্পে যা ছিল তার চেয়ে ৪০টি ব্রিজ-কালভার্ট বেশি করা হয়েছে। জনগণের দাবি এবং কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি যে এখানে কালভার্ট ব্রিজ বাড়ালে ভালো হবে তখন সেখানে বাড়িয়ে দিয়েছি। এখানে আসার পর আমরা আলোচনা করছি যে ত্রিমোহিনী এলাকায় আরও কয়েকটি ব্রিজ-কালভার্ট করে দেব, ভবিষ্যতে যাতে বন্যার পানি নিয়ে কোনো সমস্যা না হয়। আগামী ১০০ বছরের কথা মাথায় রেখে এ ব্রিজ-কালভার্ট দেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে পাথর দিয়ে রেল লাইনও উঁচু করা যাবে। টেকনিক্যাল টিমের সঙ্গে বসে দ্রুত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন সারিয়ে তোলা হবে। সেপ্টেম্বরের দিকে সব কাজ শেষ করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ট্রায়াল রানের পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ চালু হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতামত ॥ দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় সড়ক ও রেল হতে হবে উড়াল। কারণ পাহাড়ি ঢল যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে। বাংলাদেশের ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল আগেও হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর পরিমাণ এখনও আরও বাড়বে। তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বাঁধের ওপর রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় সড়ক ও রেল হতে হবে উড়াল। কারণ পাহাড়ি ঢল যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশের প্লাবনভূমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার উড়াল বা এলিভেটেড করার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘এই ধরনের বৃষ্টিপাত এখন আর অস্বাভাবিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টির ঘটনা বাড়বে। তাহলে এই যে রেল লাইনটা বানানো হয়েছে, যেটা উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত আর পানির ঢল নেমে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এসে সাগরে যাবে। এটা ডিজাইন করার সময় এই ফ্যাক্টরটা কনসিডার করার প্রয়োজন ছিল। তাই রেল লাইন প্রকল্প পরিকল্পনার সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। কম সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের বিষয়টি নজরে রাখা হয়নি।’ এজন্য অনেকের দায় আছে বলে মনে করেন তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।