তাওবাহ-ইসতেগফার আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। গোনাহ বা অন্যায় করার পর আবার তাওবাহ করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তাআলা খুব খুশি হন। এ কারণেই পাপ যেমনই হোক না কেন, তাওবাহ-ইসতেগফারের মধ্যেই রয়েছে বান্দার ক্ষমা পাওয়ার উপায়। আজকের তারাবিহতে আল্লাহ তাআলার এ ঘোষণা পড়া হবে।
চতুর্থ তারাবিহ আজ। সুরা নিসার ৮৮ আয়াত থেকে শেষ (১৭৬) পর্যন্ত এবং সুরা মায়েদার ৮২নং আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে আজ। আজকের তেলাওয়াতের অংশে তাওবাহর মাধ্যমে ক্ষমার প্রার্থনা কথা বলা হয়েছে এভাবে-
وَمَن يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللّهَ يَجِدِ اللّهَ غَفُورًا رَّحِيمًا
‘যে গোনাহ, করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১১০)
এ আয়াতে ‘সুআন’ এবং ‘জুল্ম’ শব্দ দুইটি দ্বারা ছোট এবং বড় পাপ বোঝানো হয়েছে। ‘সুআন’ হলো সেই পাপ বা অন্যায়; যা দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়। যেমন কারো প্রতি অপবাদ দেয়া বা কারো বদনাম করা। আবার জুল্ম দ্বারা ওই পাপকে বোঝানো হয়েছে, যা নিজের প্রতি করা হয়। যে পাপের অনিষ্টতা নিজের ওপর আসে।
সুতরাং পাপ বা গোনাহ ছোট কিংবা বড় হোক এর থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে তাওবাহ-ইসতেগফার। তাওবাহ করলে মহান আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন।
কোনো দোষী বা অন্যায়কারীকে যদি কেউ জেনেশুনে ছলচাতুরী করে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে, তাতে ওই অন্যায়কারীর পাপ মোটেও ক্ষমা হবে না। বরং ক্ষমা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর কাছে তাওবাহ করা। যে পাপ বা অন্যায় করে সে জানে যে, সে অপরাধী। আর এ অপরাধের জন্য তাওবাহ করার বিকল্প নেই। একমাত্র তাওবাহ করলেই রয়েছে ক্ষমার সুযোগ।
সুরা নিসার ৮৮ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো-
- মুনাফিকদের ব্যাপারে কুরআনের নীতি : ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওয়ানা হয়ে যারা পিছু হটেছিল, তাদের ব্যাপারে আলোচিত হয়েছে।
- দিয়ত বা রক্তপণের বিধান। এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে হত্যা করলে তার দিয়ত বা রক্তপণ কি হবে এ সম্পর্কিত বিষয়াদি ওঠে এসেছে সুরা নিসার ৯২নং আয়াতে।
- হিজরত প্রসঙ্গ। দ্বীন এবং ঈমান বাঁচানোর লক্ষ্যে হিজরত করা ইসলামে ফরজ। হিজরতের বিধান, পরিচয়, উপকারিতা, বরকত ও ফজিলত আলোচিত হয়েছে। সুরা নিসার ১০০নং আয়াতে ইসলামের জন্য মুমিন মুসলমানের হিজরতকারীর উপকারিতা ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হিজরত করতে গিয়ে যদি কেউ মৃতু্যবরণ করে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কারের ঘোষণা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যে কেউ আল্লাহর পথে দেশত্যাগ করে, সে এর বিনিময়ে অনেক স্থান ও সচ্ছলতা প্রাপ্ত হবে। যে কেউ নিজ গৃহ থেকে বের হয় আল্লাহ ও রসূলের প্রতি হিজরত করার উদ্দেশে, অতঃপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তার সওয়াব আল্লাহর কাছে অবধারিত হয়ে যায়। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।' (সুরা নিসা : আয়াত ১০০)
- নামাজে কসরের বিধান, কখন কসর করা যাবে। আবার শত্রুর আক্রমনে নামাজের বিধান কেমন হবে বা ভয়কালনি নামাজের পদ্ধতিই বা কেমন হবে এ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে সুরা নিসার ১০১ থেকে ১০৪নং আয়াতে।
- ক্ষমা লাভে তাওবার গুরুত্ব, তাওবার জরুরি বিষয়াবলী, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইজমার গরুত্ব, তা অস্বীকারের পরিণতি এবং জুলুম-অত্যাচারের ধরন ও আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্তের শাস্তি, মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তানের কর্মফল নির্ধারণের মূলনীতি আলোচিত হয়েছে ১১০ নং আয়াত থেকে ১২৬নং আয়াতে।
- সুরা নিসার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নারী ও শিশু অধিকার, দাম্পত্য জীবনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ও ভারসাম্য রক্ষা করার নীতি আলোচিত হয়েছে ১২৭ ও ১২৮নং আয়াতে।
- দুনিয়ায় মানুষের কর্মফল নির্ধারণের মূলনীতি আলোচিত হয়েছে ১৩৪নং আয়াতে।
- কোনো ঈমানদারের কুফরি করার পরিণতি ও মুনাফিকের পরিচয় ও তা থেকে বেঁচে থাকার উপায় আলোচিত হয়েছে ১৩৭-১৪৭নং আয়াতে।
- ইয়াহুদিদের অঙ্গীকার ভঙ্গ, হঠকারিতা, ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন এবং ইয়াহুদিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানের বিষয়সহ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান গ্রহণের শর্ত ও তাঁর মুজিযা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ১৫৩ থেকে শেষ পর্যন্ত আয়াতে।
সুরা মায়েদা
সুরা মায়েদা কুরআনুল কারিমের ৫ম সুরা। এর আয়াত সংখ্যা ১২০ রুকু সংখ্যা ১৬। সুরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ৬ হিজরির শেষের দিকে অথবা ৭ হিজরির প্রথম দিকে এ সুরাটি নাজিল হয়।
সুরাটিতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান তুলে ধরা হয়েঝে। ওজু ও তায়াম্মুমের ফরজগুলো ওঠে এসেছে এ সুরায়। মমিন মুসলমানের ইবাদতের জন্য ওজু করা ফরজ। আবার অপবিত্র হলে কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে মুমিন সে বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। আর যদি পানি পাওয়া না যায় তবে কীভাবে তায়াম্মুম করবে তাও তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্যে দাঁড়াতে চাও, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং উভয় পা টাখনুসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায় খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।' (সুরা মায়েদা : আয়াত ৬)
আজকের সুরায় ওহুদ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মদিনা ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থা এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়কার উল্লেখ যোগ্য বিষয়াবলী নিয়ে নাজিল হয়েছে সুরা মায়িদা। আজ এ সুরার ১ থেকে ৮২নং আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। আয়াতগুলোর সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলো হলো-
> আয়াত ১ থেকে ৮২
- ইহরাম অবস্থায় শিকারের বিধান, যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ বছরর ৪টি সন্মানিত মাসে আলোচনা, ঈদ আনন্দ উদযাপনের ইসলামি নীতিমালাসহ প্রাণী বা জন্তু শিকার ও তার বিধান ওঠে এসেছে এ সুরায়।
- আহলে কিতাব (ইয়াহুদি-খ্রিস্টান) নারীদের বিয়ে করার বিধানের পাশাপাশি মুশরিক নারীদের বিয়ে করার বিধানও আলেচিত হয়েছে এখানে।
- নামাজের জন্য অজু ও তায়াম্মুমের বিধান, দুনিয়ার যাবতীয় কাজে সাক্ষ্য দানের রীতিনীতি, আহলে কিতাবের অঙ্গীকার ভঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ ওঠে এসেছে।
- লেনদেন তথা করজে হাসানার বিধান, বনি ইসরাইলের প্রতি আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের বর্ণনা, হাবিল কাবিলের ঘটনা ও আনুষাঙ্গিক তাৎপর্য, মানুষ হত্যার পরিণতি, কুরআনি আইন বাস্তবানের অভিনব ও বৈপ্লবিক পদ্ধতি এবং ইসলামি শরিয়তের শাস্তির ধরন আলোচিত হয়েছে।
- চোরের শাস্তি, ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমের মামলা-মুকাদ্দমা বিধান, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে আহলে কিতাবদের ধৃষ্ঠতাপূর্ণ উক্তি ও তার পরিণতির ঘোষণা, বনি ইসরাইলের কুপরিনাম ও নাসারাদের মানসিকতা আলোচিত হয়েছে আজকের পঠিত তারাবিহ অংশে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের উল্লেখিত বিষয়গুলো বুঝে বাস্তব জীবনে আমল করার তাওফিক দান করুন। পাপ বা অন্যায় যেমনই হোক আল্লাহর কাছে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।