কিছু মাস দিন ও মুহূর্ত আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন। মহররম তার একটি। এটি হিজরি বছরের প্রথম মাস। এ মাসের ১০ তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বলা হয়। এটি ব্যাপক পরিচিত আরবি শব্দ। যার অর্থ দশম। হিজরি বর্ষের মহররম মাসের ১০ তারিখকে বুঝায়। ১৪৪৫ হিজরি বছরে এ দিনটি আগামী ২৯ জুলাই শনিবার উদযাপিত হবে। ২৮ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই আশুরা শুরু হবে। এ মাসের রয়েছে বিশেষ ফজিলত ও অনেক করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়। সেগুলো কী?
মহররমের তাৎপর্য: ফজিলতপূর্ণ মাসগুলোর মধ্যে অন্যতম মহররম। এটি আরবি ১২টি মাসের মধ্যে ৪টি হারাম মাসের একটি। এ ছাড়া এটি আরবি বছরের প্রথম মাস। আল্লাহর গণনায়ও মাস ১২টি। এ ১২ মাসের মধ্যে সম্মানিত হারাম মাস ৪টি। যে মাসগুলোতে যাবতীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাতকে মহান আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন। তন্মধ্যে মহররম একটি। এটি হিজরি বছরের প্রথম মাস। যা হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তাবনায় হিজরি বছরের প্রথম মাস হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
কোরআনে ঘোষিত সম্মানিত চার নিষিদ্ধ মাস কোনটি? এ সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে-
হজরত আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনটি হলো ধারাবাহিক মাস- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আর একটি হলো রজব মাস। জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস অর্থাৎ রমজানের আগের মাসের আগের মাস।’ (বুখারি)
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে এ চারটি মাসকে সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ যে মাসগুলোকে সম্মানিত মাস বলে অভিহিত করেছেন, সে মাসগুলোকে মর্যাদা দেয়া মুমিন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্যতম দুটি নির্দেশ হলো-
মহররমের মর্যাদা: আল্লাহ তাআলার কাছে যে মাসগুলো সম্মানিত, সে মাসগুলোকে সম্মান দেখানো ও মর্যাদা দেওয়া মুমিনের প্রথম কাজ। মহররমসহ এ মাসগুলোতে আল্লাহর দেওয়া সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা প্রত্যেক ঈমানদারের প্রথম করণীয়।
কিন্তু মুমিন মুসলমানের অনেকেই জানেন না যে, ইসলামের সম্মানিত ও মর্যাদার মাস কোনগুলো। মানুষ যখন জানবে যে এ মাসগুলো সম্মানিত। তখন মানুষের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হবে যে, আসলেই এটি মহররম মাস। এ মাসের যাবতীয় পাপাচার নিষিদ্ধ। তাই সস্মানিত মাসগুলো সম্পর্কে যেমন জানা জরুরি। তেমনি হারাম মাসের ইবাদত ও আমল সম্পর্কে ধারণা নেয়া জরুরি।
পাপমুক্ত থাকার মাস: আল্লাহর দেওয়া সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে মহররমসহ সম্মানিত ৪ মাসের দুনিয়ার যাবতীয় পাপাচার থেকে মুক্ত থাকা মুমিন মুসলমানের দ্বিতীয় কাজ। তবেই জীবনের বাকি সময়গুলো এ মাসের অনুসরণ ও অনুকরণে গুনাহমক্ত থাকা সহজ হবে। এ মাসগুলোর করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘এ (মাসের) মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি কোনোরূপ অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৩৬)
আয়াতের ব্যাখ্যা তাফসির বিশারদগণ বলেছেন, অত্যাচার বলতে এখানে যে কোনো ধরণের পাপাচার করাকে বুঝানো হয়েছে। তাই এ মাসের পাপাচার না করাই কোরআনে নির্দেশিত সেরা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আমল।
এমনিতে অন্যান্য মাসে গোনাহের কাজ করা মুমিন মুসলমানের জন্য জঘন্য কাজ। আর সম্মানিত চার মাস জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাসের পাপাচার করা দ্বিগুণ মারাত্মক অন্যায় ও সরাসরি মহান আল্লাহর নির্দেশের লঙ্ঘন।
সওয়াবের প্রতিযোগিতার মাস: সওয়াব ও ভালো কাজের প্রতিযোগিতা করা এ মাসের তৃতীয় কাজ। ইসলামিক স্কলারদের মতে, সম্মানিত ৪ মাসের মধ্যে মহররম মাসই শ্রেষ্ঠ। তাই এ মহররম মাসে গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি যেসব কাজে সওয়াব ও উপকারিতা রয়েছ, সেসব কাজের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেওয়া খুবই জরুরি। আবার মর্যাদার বিচারে রমজানের পরেই এ মহররম মাসের স্থান। কেননা মহররম শব্দের অর্থই হলো- সম্মানিত।
মহররমকে মর্যাদা দেওয়ার কারণ কী?
মাসটির নাম হলো ’মহররম’। এর অর্থ : সম্মানিত। হাদিসেও এ মাসটিকে আল্লাহর মাস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এটি (মহররম) শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস।’ (মুসলিম)
মহররমের রোজা: নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো মহররম মাসের রোজা।’ (মুসলিম)
ক্ষমার ঘোষণা: আশুরার দিন ও মহররম মাসজুড়ে বেশি তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা এ দিন ও মাসের বিশেষ মুহূর্তে তাওবাহ-ইসতেগফারে আল্লাহ তাআলা পুরো জাতিকে ক্ষমা করে দেবেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)
আত্মত্যাগের উপমা: দ্বীন ও ইসলামের কল্যাণে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবন থেকে আত্মত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করা সব মুসলমানের জন্য একান্ত করণীয়। যাদের মাঝে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ ঈমানি চেতনা জাগরিত হলেই ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় আসবে।
মহররমে রোজাদারকে ইফতার করানো: এমনিতে ইফতার করানো অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ। সম্ভব হলে আশুরার দিনে নিজে রোজা রাখার পাশাপাশি রোজা পালনকারীদের ইফতার করানো উত্তম। সাধ্যমত দান-সাদাকাহ করা। গরিবদেরকে পানাহার করানো। ইয়াতিমের প্রতি সদয় ব্যবহার ও সহযোগিতা করা।
মহররম মাসে বর্জনীয়
১. হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর বানানো থেকে বিরত থাকা।
২. তাযিয়া বানিয়ে তা কাঁধে বা যানবাহনে বহন করে মিছিলসহ সড়ক প্রদক্ষিণ করা থেকেও বিরত থাকা।
৩. নকল এসব তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা এবং এসব তাযিয়া বা নকল কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ দান করা থেকেও বিরত থাকা।
৪. হজরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর স্মরণে নিজেদের দেহে আঘাত বা রক্তাক্ত করা থেকে বিরত থাকা।
৫. শোক বা মাতম করা থেকে বিরত থাকা।
৬. যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা থেকে বিরত থাকা।
৭. হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে বিলাপ, মাতম কিংবা মর্সিয়া ও শোকগাঁথা প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বুকে পেটে পিঠে ছুরি মেরে রক্তাক্ত করা থেকেও বিরত থাকা।
৮. ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের বাদ্যযন্ত্রের তালে প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকা।
৯. হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহুর নামে ছোট বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মহররম বিষয়ক একটি কু-প্রথাও বটে।
১০. আশুরায় শোক প্রকাশের জন্য নির্ধারিত কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা।
১১. আশুরা বা ১০ মহররমকে কেন্দ্র করে এসব প্রচারণা থেকে বিরত থাকা জরুরি-
> ১০ মহররম পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়।
> কেয়ামত সংঘটিত হওয়া।
> হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামের সৃষ্টি। বেহেশতে প্রবেশ। আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হওয়া।
> হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আগুন থেকে নাজাত।
> হজরত নুহ আলাইহিস সালামকে মহাপ্লাবন থেকে নিষ্কৃতি ও পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস।
> এই দিনেই অত্যাচারী শাসক নমরূদের ধ্বংস।
উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং মিথ্যা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহান্নামে নিজেদের ঠিকানা বানানো থেকে বিরত থাকাই জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরার ফজিলত পেতে করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। বর্জনীয় ও মিথ্যা ঘটনা বর্ণনা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।