২৭ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার, ০২:৪৮:১৬ অপরাহ্ন


অর্থনীতিতে স্বস্তি
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০২-২০২৩
অর্থনীতিতে স্বস্তি ফাইল ফটো


আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের পর এবার আরও চার উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের খরা কেটে এখন বইছে সুবাতাস। একক মাস হিসেবে এ যাবতকালের রেকর্ড ৫৩৭ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে গত ডিসেম্বর মাসে। ডলার-সংকটের কারণে যখন নিত্যপণ্য আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে, ঠিক তখন জানুয়ারি মাসে প্রায় ১৯৬ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এতে করে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে।

ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে ডলার সংকট। আসন্ন রমজান পরবর্তী ঈদকে ঘিরে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নানামুখী কর্মতৎপরতা শুরু করেছেন। কোরবানি সামনে রেখে গবাদি-পশুর খামারগুলোতে গরু-ছাগল লালন-পালন শুরু করেছেন খামার মালিকরা। আগামী মাসে শুরু হবে খুশির ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা। বিদেশে অবস্থানরত কোটি প্রবাসীরা প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটাতে আরও বেশি করে রেমিটেন্স পাঠাবেন দেশে। এতে করে দীর্ঘদিনের জমে থাকা কালো মেঘ কেটে অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। 
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ অনুমোদনের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ঋণদাতা সংস্থা বাংলাদেশের অনুকূলে এবার বাজেট সহায়তা দ্বিগুণ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এছাড়া এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দিতে যাচ্ছে।

এই চার সংস্থার কাছ থেকে আগামী চার বছরে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে মহামারি করোনা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাপে নানামুখী চাপে থাকা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
বিশেষ করে আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কখা বলেছে তাতে দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পরিপালন করা হলে এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটা ঠিকই আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি এ মুহূর্তের অর্থনীতির জন্য বড় একটি ঘটনা।

এখন তাদের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকসহ আরও কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী তাদের সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করার কথা জানিয়েছে। শুধু তাই নয় রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়েও চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। 
তিনি বলেন, পুরো বিষয়টিকে ভালভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে এতদিন যেসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল আসলে সেই শঙ্কা কেটে যাচ্ছে। তবে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তা পরিপালনে প্রথম থেকেই সরকারকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সংস্থাটির এই ঋণ কার্যক্রম নিয়ে সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, অপচয়রোধে সরকারের ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধনে নজরদারি বাড়ানো দরকার। ব্যয় কমাতে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। 
রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের খরা কেটে যাচ্ছে ॥ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়। এই দুই খাত থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশী মুদ্রা আসে বাংলাদেশে। রপ্তানি খাত থেকে প্রতিবছর ৬ হাজার কোটি ডলার এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। গত কয়েক বছর ধরে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সরকারি-বেসরকারি খাত। কিন্তু করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

এখন সারাবিশ্বে আরেকটি অর্থনৈতিক মহামন্দা বিরাজ করছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে দিয়ে অর্থ সাশ্রয় করছেন। এতে করে চাপে আছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। এমনকি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আহরণ কমে আসছিল। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। খরা কেটে যাচ্ছে এই দুই খাতের। রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। সংকটের মধ্যেও পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত জানুয়ারি মাসে ৫১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। 
এ আয় গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২০৯ কোটি টাকার সমান। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা, প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। 
বাংলাদেশের পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রপ্তানিকারকরা উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে বিশ্বমন্দার কারণে বিদেশে পোশাকের ন্যায্যদাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি বাড়ায় উদ্যোক্তারা খুশি। তবে ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো মেটানোর দিকে নজর দেওয়া হলে আরও বেশি আয় করা সম্ভব। 
তিনি বলেন, বিশ্বে এখন আমাদের ইমেজ আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে যেখানে ১০ ডলারের বেশি দামের শার্টের অর্ডার এদেশে আসত না, এখন সেখানে ২০ ডলারের শার্টের অর্ডারও আমরা পাচ্ছি। ১৫ ডলারের জ্যাকেটের পাশাপাশি এখন ২৫-৩০, এমনকি ৩৫-৪০ ডলারের জ্যাকেটের অর্ডারও আসছে। শুধু তাই নয়, ভারত, কোরিয়া, জাপানের মতো অপ্রচলিত বাজারে পণ্য রপ্তানির হার বেড়েছে। এসব কারণেই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও রপ্তানি আয় শক্তিশালী হচ্ছে।
এছাড়া গত জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ডলারের আয় দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ আয় গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ১৪ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। ডলার-সংকটের কারণে যখন নিত্যপণ্য আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে, ঠিক তখন সুখবর দিল প্রবাসী আয়ে। 
ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনায় চাঙা হবে অর্থনীতি ॥ আসন্ন রমজান মাস থেকেই শুরু হবে ঈদের কেনাকাটা। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা ঈদকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এই ঈদকে ঘিরে কয়েক লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয় সারাদেশে। ফলে অর্থনীতির সকল খাতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, ঈদ সামনে রেখে রমজানের মাসের শুরু থেকেই প্রবাসীরা আপনজনদের কাছে ডলার পাঠাতে শুরু করেন। ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসে দেশে বিদেশী মুদ্রা ডলারের জোগান আরও বাড়বে।

এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া রমজানের ঈদ পরবর্তী দুই মাসের ব্যবধানে কোরবানির ঈদ রয়েছে। এই ঈদকে ঘিরেও শত কোটি টাকার গবাদি পশু বেচাকেনা হবে সারাদেশে। ইতোমধ্যে খামারিরা কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ ও লালন-পালন শুরু করেছেন।

ওই সময়ও দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আসবে। এ কারণে আগামী কয়েকমাস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশী মুদ্রার জোগান অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে আগামী অর্থনীতি হবে সাফল্য ও সম্ভাবনার। ইতোমধ্যে সারাদেশে রোজার ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। রোজার এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হয় ঈদের কেনাকাটা।

ঈদকে ঘিরে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকা, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানার মালিকরা বাহারি পোশাক বানানো শুরু করেছেন। শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি পিস, জুতা, স্যান্ডেলের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক্স, ফার্নিচার, গাড়ি, জমি-ফ্ল্যাটসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ে ঈদকে ঘিরে। 
এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী জনকণ্ঠকে বলেন, রোজা সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা ঈদের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ডিজাইন, রঙ ও মডেলের পণ্য বানাতে শুরু করেছেন। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আশা করছি, এবার ঈদে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেচাবিক্রি হবে দেশে। তিনি বলেন, ঈদকে ঘিরে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা সারাবছর মুখিয়ে থাকেন রমজান মাসের জন্য। সেই মাস শুরু হচ্ছে মার্চ মাস থেকে। 
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আসবে ১১০০ কোটি ডলার ॥ আগামী চার বছরে আইএমএফসহ অন্য চার উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে প্রায় ১১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা আসবে। ইতোমধ্যে আইএমএফের বোর্ড সভায় বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। যার প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পেয়েছে সরকার। এছাড়া আগামী চার বছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ১৭৫ কোটি ডলার, এডিবি থেকে ২০০ কোটি ডলার, জাইকা ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যদের কাছ থেকে প্রায় ২১২ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে।

এতে করে এই পাঁচ উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকেই মিলবে প্রায় ১১০০ কোটি ডলার। এর পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকেও ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর উদ্যাপন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে গত ২১ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ফন টর্টসেন বাংলাদেশ সফর করেন।

এই সফরকালে তিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বাজেট সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। সংস্থাটি সহযোগিতা কার্যক্রম বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।