২৭ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার, ১২:৪০:৩৬ অপরাহ্ন


৫০০ সিসির মোটরসাইকেল অনুমতি পেলে লাভ কী, ক্ষতি কী কী
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০২-২০২৩
৫০০ সিসির মোটরসাইকেল অনুমতি পেলে লাভ কী, ক্ষতি কী কী ৫০০ সিসির মোটরসাইকেল অনুমতি পেলে লাভ কী, ক্ষতি কী কী


৫০০ সিসি পর্যন্ত ইঞ্জিনক্ষমতার মোটরসাইকেল আমদানি বিষয়ে নীতি সংশোধনের উদ্যোগ। কেউ কেউ বলছেন, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়াবে।


আমদানি নীতিতে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়।


দেশে মোটরসাইকেলের সিসি (ইঞ্জিনক্ষমতা) সীমা ১৬৫-তে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি ৫০০ সিসি পর্যন্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে, তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।


বেসরকারি কোম্পানিগুলো দেশে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল সংযোজন অথবা উৎপাদন এবং বাজারে ছাড়ার সুযোগ চায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর বিপক্ষে। তারা মনে করে, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল বাংলাদেশের বাজারে ছাড়ার সুযোগ দিলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত যেসব নীতি নেওয়া হয়েছে, তা ঠিক হয়েছে বিভিন্ন পক্ষের তদবির ও চাপে। তবে সরকারের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও যুক্তির ভিত্তিতেই নীতি ঠিক হওয়া উচিত।

মোটরসাইকেলের সিসিসীমা নিয়ে বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি নীতি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কার্যকর করা আমদানি নীতি আদেশে (২০২১-২০২৪) ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির সুযোগ আছে। যন্ত্রাংশ আমদানি করে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল দেশে তৈরি করতে পারবে কোম্পানিগুলো। বাজারেও ছাড়তে পারবে।


যদিও দেশে এখনো উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল আমদানি শুরু হয়নি। এর আগে দেশে ১৬৫ সিসির বেশি ক্ষমতার মোটরসাইকেল আমদানি করা যেত না।


আমদানি নীতি সংশোধন নিয়ে গত ১৫ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে ৫০০ সিসি পর্যন্ত ক্ষমতার মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করা যাবে শুধু তৈরি করে রপ্তানির উদ্দেশ্যে। এর মানে হলো, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল বাজারে ছাড়া যাবে না।


সিদ্ধান্তটি জানার পর সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ মোটরসাইকেল সংযোজনকারী ও উৎপাদক সমিতির (বিএমএএমএ) একটি প্রতিনিধিদল। তারা উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল উৎপাদন অথবা সংযোজনের জন্য যন্ত্রাংশ আমদানি ও বাজারে ছাড়ার সুযোগ রাখার দাবি জানায়।


কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তাদের প্রস্তাব পর্যালোচনার কথা বলেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।


জানতে চাইলে ভারতের টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব কুমার রায় গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন কোনো খবর তাঁরা এখনো পাননি।


সিসি বিতর্ক যেভাবে এল

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দেশে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোটরসাইকেলের সিসিসীমা ছিল ১৫৫। ওই বছর আগস্টে তা বাড়িয়ে ১৬৫ করা হয়। পুলিশের ক্ষেত্রে কোনো সীমা ছিল না।


মোটরসাইকেল আমদানিকারকেরা সব সময় সিসিসীমা বাড়াতে তৎপর থাকেন। তবে বিরোধিতা করে পুলিশ ও বিআরটিএ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হতো, অপরাধীরা উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল ব্যবহার করে অপরাধ করলে তাদের ধরা সম্ভব হবে না। বিআরটিএ সামনে আনে দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে।


সিসিসীমা পুরোপুরি তুলে নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০২০ সালের শেষ দিকে। তখন ইফাদ অটোস বাংলাদেশে রয়েল এনফিল্ড ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিল। জাপানি ব্র্যান্ড কাওয়াসাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর একটি চিঠি দিয়ে সিসিসীমা ২৫০-এ উন্নীত করার আবেদন করে। উল্লেখ্য, রয়েল এনফিল্ডের তুলনামূলক কম সিসির কোনো মোটরসাইকেল নেই।


ইফাদ অটোসের চেষ্টা বাধার মুখে পড়ে দেশে কারখানা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে। তাদের বক্তব্য ছিল, হঠাৎ করে সিসিসীমা তুলে নেওয়া হলে দেশের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দেশে উৎপাদনের শর্তে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির অনুমতি দেওয়া যায়। সে অনুযায়ী আমদানি নীতি আদেশ তৈরি হয়েছিল। অবশ্য এর আগেই রানার অটোমোবাইলসকে শুধু রপ্তানির শর্তে ৫০০ সিসি ক্ষমতার মোটরসাইকেল উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।  


বাংলাদেশে এখন ৯টির মতো মোটরসাইকেল কারখানা হয়েছে। সরকার ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতি করে, যেখানে ২০২৭ সালের মধ্যে দেশে ১০ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এখন বছরে ৬ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।


সিসি বিতর্ক কেন

মোটরসাইকেলের সিসি নিয়ে দুই পক্ষের মত দুই রকম। কোম্পানিগুলো মনে করে, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলে নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য বেশি। আর বাংলাদেশে মূলত বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর বাজার বড়। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো কম সিসির মোটরসাইকেলের বৈশিষ্ট্য উন্নত করতে এখন আর গবেষণায় জোর দেয় না। অন্য কোনো দেশে সিসিসীমা নেই। তাই বাংলাদেশে এটা রাখার মানে নেই।


বাংলাদেশ মোটরসাইকেল সংযোজনকারী ও উৎপাদক সমিতির পক্ষ থেকে গত ২৯ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। কারও কারও যন্ত্রপাতি এসে গেছে। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হলে বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে বিরূপ বার্তা যাবে।


বেনেলি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী ডিএইচএস মোটরবাইকসের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দেশেই মোটরসাইকেলে সিসিসীমা নেই। বাংলাদেশের নীতিটি অদ্ভুত।


উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলে গতি বেশি ওঠে কি না, জানতে চাইলে দুটি মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সিসির সঙ্গে গতির আংশিক সম্পর্ক রয়েছে। বেশি সিসির মোটরসাইকেলে গতি কম সিসির মোটরসাইকেলের চেয়ে বেশি হয়। তবে পার্থক্য বেশি নয়।


বিআরটিএসহ কারও কারও যুক্তি, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা যে হারে বাড়ছে, তাতে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল নতুন বিপদের কারণ হবে। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৫৩৩ জন। সংখ্যাটি আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি।


সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটিএ সংস্থাপন শাখা থেকে গত ১৩ নভেম্বর বাণিজ্যসচিবকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সিংহভাগই উঠতি তরুণসমাজ। সিসিসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হলে তরুণ ব্যবহারকারীরা গতিসীমা অতিক্রম করে মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে চলাচল করবে। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।


শুধু দুর্ঘটনা নয়, সামনে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতিও। কেউ কেউ বলছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। বিভিন্ন পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি ডলার-সংকটে ব্যাহত হয়েছে নিত্যপণ্যের আমদানিও। এমন সময়ে উচ্চ সিসির বেশি দামি মোটরসাইকেল আমদানির সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।


জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বাস সেবা অপ্রতুল, তাই পরিবহনের জন্য মোটরসাইকেল দরকার—এটা যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেখানে তো উচ্চ সিসির, উচ্চগতির মোটরসাইকেল দরকার নেই।


বাংলাদেশের সড়ক গতির ঝড় তোলার জন্য প্রস্তুত নয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যে উচ্চগতির মোটরসাইকেল শুধু ঝুঁকিই বাড়াবে।


সামছুল হক আরও বলেন, সমাজের প্রতি সরকারের দায় আছে। যে যা-ই বলুক, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বুঝেশুনে।