ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ অনুসন্ধান করে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সাথে তিন ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার সাথে জড়িতদের তালিকাও চেয়েছেন আদালত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাও জানাতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া আদেশে এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার বিষয় ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন আদালত।
গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ওই তিনটি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
আদেশে ঋণ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন আদালত। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে অর্থ, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুদক চেয়ারম্যান, বিএফআইইউ ও সিআইডি প্রধানদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া আদেশে আদালত তিনটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ঋণ লেনদেনের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের নাম ও ঠিকানার তালিকা জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদেশের সময় আদালত বলেছেন, আমরা কোনো পক্ষ না, আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটি যাচাইয়ের জন্য আদেশ দিচ্ছি। আমরা যেভাবে শপথ নিয়েছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো বিষয় থাকে সেটি আমরা দেখব।
আগামী বছরের ৫ এপ্রিল এ বিষয়ে শুনানির পরবর্তী দিন রেখেছেন আদালত।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার আবেদন করেন।
আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্ট এসেছে সে বিষয়ে এস আলম গ্রুপকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া এ বিষয়ে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আমাদের জানাতে বলেছেন আদালত।
আদেশের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মানিক বলেন, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, সেসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন। ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংবাদের সত্যতা যাচাই ও তদন্ত করে আগামী ৫ এপ্রিল প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। ঋণ নেয়ার বিষয়ে এস আলম গ্রুপকেও জানাতে বলা হয়েছে।
এর আগে তিন ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশতি প্রতিবেদন নজরে এনেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। পরে হাইকোর্ট তাকে রিট করতে বলেন। তবে শিশির মনির রিট না করে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তার কাছে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে চিঠি দেন। বৃহস্পতিবার এ আবেদনটি করেন ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরসহ পাঁচজন। আবেদনকারী অন্যরা হলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ সাদিক, মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী যায়েদ বিন আমজাদ ও অপর শিক্ষার্থী শায়খুল ইসলাম ইমরান।
চিঠিতে বলা হয়, প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, নভেম্বর মাসের ১ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। আর ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। দি বিজনেস স্টান্ডারের রিপোর্ট অনুযায়ী মেডিগ্রিন এক হাজার কোটি টাকা ও এস এস স্ট্রেট লাইন নয় শ’ কোটি টাকা নিয়মবর্হিভূত লেনদেন করেছে। তাই এসব ঋণের বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে চিঠিতে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, জামানত ছাড়া ঋণ প্রদান, নামসর্বস্ব কোম্পানিকে ঋণ প্রদানের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠে এসেছে। ব্যাংকের কর্মচারীসহ প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী ও সুধীজনের ভাষ্যমতে, রিপোর্টে উল্লিখিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত অসাধু লেনদেনের পরিমাণ আরো অনেক গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে। আর এ ধরনের অসাধু লেনদেন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অধিকতর অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ শিরোনামে গত ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইসলামী ব্যাংকের ৭,২৪৬ কোটি টাকা ঋণের তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক শিরোনামে গত ২৯ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে এবং এস আলম গ্রুপ একাই আইবিবিএল থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ তুলেছে শিরোনামে গত ৩০ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক নিউ এজে পৃথক প্রতিবেদন ছাপা হয়।
এ দিকে ইসলামী ব্যাংকের ঋণে অনিয়ম, রিট করার পরামর্শ হাইকোর্টের এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আদালত। গতকাল রোববার বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, গণমাধ্যমে এসেছে আমরা নাকি রিট করতে পরামর্শ দিয়েছি। আমরা কোনো কনসালটেন্সি ফার্ম (পরামর্শক সংস্থা) নই, যে আমরা কাউকে পরামর্শ দেবো।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, আপনারা সঠিক তথ্য তুলে ধরে রিপোর্ট করবেন। আমরা কোনো পক্ষে না। আমরা দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। বিচারক বলেন, সব সময় সত্যটা তুলে ধরতে হবে। আর কোর্ট রিপোর্টের ক্ষেত্রে আইনগত জ্ঞান থাকতে হবে বলেও উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। এ সময় ভবিষ্যতে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে বললেন বিচারক। এর আগে ইসলামী ব্যাংকের ভয়ঙ্কর নভেম্বর শিরোনামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে আদেশ প্রার্থনা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। তখন আদালত তাকে বিষয়টি নিয়ে যথাযথভাবে রিট করতে বলে।