বাংলাদেশে ডিডিটি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এর ধ্বংস প্রক্রিয়া সম্পর্কে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল জানান, ডিডিটি পুড়িয়ে যে ছাই হবে সেটিও সাবধানে সংরক্ষণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, পুড়ানোর সময় যে গ্যাস বের হবে সেটিও সংরক্ষণ করতে হবে।
নিষিদ্ধের তিন দশক পর ক্ষতিকর রাসায়নিক ডাইক্লোরোডিফেনাইলট্রিক্লোরোইথেন (ডিডিটি)-এর সবচেয়ে বড় মজুত ধ্বংসের জন্য চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো হচ্ছে ফ্রান্সে।
শুক্রবার ২৪টি কন্টেইনারে ৫২০ টন ডিডিটি নিয়ে ফ্রান্সের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবে বহনকারী জাহাজ।
১৯৮৫ সালে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা নিধনের উদ্দেশে পাকিস্তান থেকে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে সরকার। কিন্তু ওই ডিডিটি নিম্নমানের হওয়ায় সে সময় তা ব্যবহার করা যায়নি। এরপর থেকেই এ রাসায়নিক চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের গুদামে রাখা হয়।
এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হওয়ায় ১৯৯১ সালে দেশে ডিডিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনের চুক্তি অনুযায়ীও সারাবিশ্বে নিষিদ্ধ এই রাসায়নিক।
ক্ষতিকর এই রাসায়নিক অবিরাম দূষক বা প্রেসিসটেন্ট অর্গানিক পলিউটেন্ট (পপস) প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করে। ক্ষতিকর এই রাসায়নিকের ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি, আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া, বংশবৃদ্ধিতে অস্বাভাবিকতা, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত, প্রজননতন্ত্রের ক্ষতিসাধন সহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়।
আমদানির ৩৭ বছর পর অবশেষে এই ক্ষতিকর রাসায়নিকটি বাংলাদেশ থেকে ধ্বংসের জন্য ফ্রান্সে পাঠানো হচ্ছে।
সম্প্রতি ৩ দফায় ২৪টি কন্টেইনারে এসব রাসায়নিক শিপিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়েছে।
বুধবার নগরীর পাঁচ তারকা হোটেল ‘রেডিসন ব্লু’ এর মোহনা হলে এই ডিডিটি অপসারণ প্রকল্পের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ক্যান্সার বেড়ে যাওয়া সরকারের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই এলাকায় ক্যান্সার নিয়ে যে চিকিৎসক কাজ করতেন তিনিও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা এও জেনেছি, মায়ের দুধেও ডিডিটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই ডিডিটি এত বছর এখানে কেন পড়েছিল এটা একটা প্রশ্ন!’
ডিডিটি ধ্বংসের দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ‘ডিডিটি মুক্তিযুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা কাজ করেছেন আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। পরিবেশ অধিদপ্তরে যে কোনো অনুষ্ঠানে আপনাদের স্মরণ করা হবে। এটার যে ইতিহাস লেখা হবে, সেখানে যারা কাজ করেছেন তাদের নামও থাকা উচিত। কারণ তাদের ক্ষতি হতে পারে। যদি তাদের নামের তালিকা থাকে তাহলে কাজের কারণে কোনো রোগে আক্রান্ত হলে সরকার ও রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে।’
এ সময় সীমান্ত দিয়ে ডিডিটি কিংবা এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক যেন দেশে প্রবশে করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও জননিরাপত্তা বিভাগকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন সচিব।
এ সময় তিনি শুটকিতে ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান রাখেন মোস্তফা কামাল।
বাংলাদেশে ডিডিটি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এর ধ্বংস প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচিব জানান, ডিডিটি পুড়িয়ে যে ছাই হবে সেটিও সাবধানে সংরক্ষণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, পুড়ানোর সময় যে গ্যাস বের হবে সেটিও সংরক্ষণ করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো- বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে ডিডিটি নিয়ে যেতে বিভিন্ন দেশের অন্তত ১৩টি বন্দরের অনুমতি নিতে হয়েছে। শুরুতে কয়েকটা দেশ আপত্তিও জানিয়েছে যে, এসব দূষিত জিনিস তাদের বন্দর দিয়ে যেতে দেয়া হবে না। পরে তাদেরকে রাজি করানো সম্ভব হয়েছে।
জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশন (এফএও) এর কীটনাশক বিশেষজ্ঞ মার্ক ডেভিস বাংলাদেশে ডিডিটির এই মজুদকে ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ডেভিস বলেন, ‘আমার জানামতে, আর কোথাও একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে এই পরিমাণ কীটনাশক অপসারণের ঘটনা ঘটেনি। এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক যে, একটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে এত দীর্ঘ সময় ধরে এটি সংরক্ষণ করা ছিল!’
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ জানান, গ্লোবাল অ্যানভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) ও জলবায়ু ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডিডিটি ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এটা ফ্রান্সে পাঠিয়ে ধ্বংস করতে হচ্ছে। কারণ আমারদের সক্ষমতা নেই। আশা করছি, এফএও সঠিক সময় এটি বাস্তবায়ন করবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এফএও এর জ্যেষ্ঠ প্রযুক্তি কর্মকর্তা সাসো মার্টিনোভ, প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ, এফএও রিপ্রেজেনটেটিভ নূর আহমেদ খন্দকার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল হামিদসহ আরও অনেকেই।