সরকারি গাড়ি ব্যবহারে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২৭ অক্টোবর শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বৈঠকে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, তারা আর সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি তারা ব্যবহার করছেন মর্মে মন্ত্রণালয় সিনিয়র সচিব/সচিবের কাছে প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে। সিনিয় সচিব/সচিব ওই প্রত্যয়নপত্রে প্রতিস্বাক্ষর করবেন। যারা সুদমুক্ত ঋণের টাকায় গাড়ি কিনেছেন, তারা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর বা সংস্থার কোনো গাড়ি ব্যবহার করছেন না বা করবেন না-এমন প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে।
এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করা চলবে না। প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করছেন না মর্মেও প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের গাড়ি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ওই প্রত্যয়নে প্রতিস্বাক্ষর করবেন। বছর শেষে মন্ত্রণালয়ের শুদ্ধাচার কৌশলপত্র চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রতিবেদনের সঙ্গে এসব প্রত্যয়নপত্র মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিতে হবে। সমাপ্ত প্রকল্পের যাবতীয় সম্পত্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিধি অনুযায়ী হস্তান্তর করতে হবে। কোনো কালক্ষেপণ করা যাবে না।
শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়নে এসব নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উল্লিখিত বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সব অনুবিভাগ, শাখা, উপশাখায় আদেশ জারি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত) ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ সোমবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, সুদমুক্ত ঋণে যারা গাড়ি কিনেছেন, তাদের প্রত্যয়ন দিতেই হবে। এটা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত। এটা শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের অংশ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সম্ভবত এটা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য প্রযোজ্য হবে।
শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকার প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুযোগ দিয়েছে। ঋণের টাকায় কিনলেও সেই গাড়ি নিজে ব্যবহার না করে তারা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করছেন। অনেকেই বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে নিজের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। অধিদপ্তরের কর্তারা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে অনেক সময় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি ব্যবহার সুবিধা দিয়ে থাকেন। আবার প্রকল্পের কর্মকর্তারা নিজেদের চেয়ার ঠিক রাখতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি ব্যবহার সুবিধা দিয়ে থাকেন। গাড়ি ব্যবহার বিষয়ে অনেক অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ নির্দেশনা। এখন একটা জবাবদিহির মধ্যে আসবে বলে আমরা মনে করি। কারণ বছর শেষে গাড়ি ব্যবহারে কে কোন ধরনের অনিয়ম করছেন তার খতিয়ান চলে যাবে এসএসবির সভাপতির কাছে। সুতরাং অনিয়ম করলে নিজেরই ক্ষতি হবে।
উল্লেখ্য, উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ইতোমধ্যে তিন বছর অতিক্রম করছেন এমন কর্মকর্তা, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবরা সুদমুক্ত গাড়ি সেবা পেয়ে থাকেন। এছাড়া অধুনাবিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের যুগ্মপ্রধান তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্মসচিব (ড্রাফটিং) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুবিধা পাচ্ছেন। তারা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভারের বেতন, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে খরচের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্টারা আরও জানান, সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের সব সম্পত্তি জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি সরকারি পরিবহণ পুলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সময়মতো জমা না হওয়ায় বিপুলসংখ্যক গাড়ির হদিস মিলছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এ বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও নেই বলে দাবি করছেন কর্মকর্তারা। এছাড়া সমাপ্ত প্রকল্পের কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার মেশিনসহ যাবতীয় সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার নিয়ম যথাযথভাবে প্রতিপালন হয় না। বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করতে এবং বছর শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগে নানা বিষয়ে বিধিমতো মতামত চাওয়া হয়। এ অনুবিভাগ থেকে নিয়োগবিধি, বিধিমালা প্রণয়ন কিংবা সংশোধন কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে হবে। বছর শেষে শুদ্ধাচার কৌশলপত্র চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে কার্যক্রম কতগুলো বিধিগত মতামত দেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা সেবা সহজ করতে বলা হয়েছে। সেবা সহজ করার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং গৃহীত পদক্ষেপের ফলে সেবা কতটা সহজ হয়েছে, ওই বিভাগের কাজের গতি কীভাবে বেড়েছে, তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর তাগিদ দিয়েছে। এছাড়া শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে মন্ত্রণালয়ের গণশৌচাগারগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বলেছে। কারণ অধিকাংশ সময় গণশৌচাগার ব্যবহার অনুপযোগী থাকে। দুর্গন্ধে বারান্দা দিয়ে হাঁটা যায় না। নেই হ্যান্ডওয়াশ কিংবা সাবানও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, শৌচাগার নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে কি না, তা হঠাৎ তারা পরিদর্শন করবে। অথচ প্রতিদিন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও কয়েক হাজার দর্শনার্থী, বিদেশি নাগরিক, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি সচিবালয়ে দাপ্তরিক কাজে প্রবেশ করছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই গণশৌচাগার ব্যবহার করেন।
একাধিক মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, করোনার সময় সাবান, হ্যান্ড সেনিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ দেওয়া হলেও এখন বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় তা আর পাচ্ছি না। ৩ জুলাই অর্থ বিভাগ থেকে সেবা খাতের বাজেটের অর্ধেক টাকা খরচ করতে নির্দেশ দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ সেবা খাতে ১০ লাখ টাকা বাজেট থাকলে খরচ করতে পারবে ৫ লাখ টাকা। এর বেশি খরচ করলে অর্থ বিভাগ সেই অর্থব্যয়ের অনুমোদন দেবে না।