২৬ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৬:৫৬:২৪ পূর্বাহ্ন


ক্ষতিপূরণের ১০০ বিলিয়ন ডলারই চায় বাংলাদেশ
অনলাইন ডেস্কঃ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১১-২০২২
ক্ষতিপূরণের ১০০ বিলিয়ন ডলারই চায় বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের ১০০ বিলিয়ন ডলারই চায় বাংলাদেশ


জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শার্ম আল শেখে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। সোমবার সম্মেলন কেন্দ্রে দুটি সাইড ইভেন্টে যোগদান করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এই দাবি জানিয়েছেন।  দাবিগুলোর মধ্যে প্রথম দাবি হচ্ছে, যে সকল দেশ বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে তাদেরকে তাদের নিজস্ব কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার টাকা দেয়ার কথা ছিল। সেটা আর আগামীতে নয়, এখনই চায় বাংলাদেশ। আর সেই টাকার ৫০ শতাংশ অভিযোজনে এবং ৫০ শতাংশ প্রশমন কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।
তৃতীয় দাবি হচ্ছে, লস অ্যান্ড ডেমেজের জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ চায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট এই ক্ষতিপূরণের অর্থ উন্নত দেশগুলোকে তাদের বাজেট থেকে শেয়ার করতে হবে। চতুর্থ দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশ সবুজ জ্বালানিতে যেতে চায়। এজন্য অর্থ ও প্রযুক্তি দরকার। বাংলাদেশ চায় উন্নত দেশ এই প্রযুক্তির জন্য টাকা দেবে, যাতে বাংলাদেশ ৪০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। পঞ্চম এবং শেষ দাবি হচ্ছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে সকল দেশকে মিলে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অর্থ পাওয়ার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। ইতোমধ্যে জার্মানি ২০ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ১২ মিলিয়ন, ফ্রান্স ৮ মিলিয়ন এবং ইউকেসহ অন্যান্য দেশ অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। আমরা চেয়েছি আরও বেশি অর্থ।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের অনেক অর্জন হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছিয়ে যাচ্ছে, এটি একটি বড় সমস্যা।
জলবায়ুু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের কি পরিমাণ আমাদের অর্থ প্রয়োজন আছে জানতে চাইলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমি মনে করি, আমাদেরই ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
মিসরের শার্ম আল শেখে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের নবম দিনে সোমবার সকালে হিউম্যান মবিলিটি ইন দ্য কনটেক্সট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ শীর্ষক এক সাইডলাইন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য নতুন অর্থায়নের দাবি জানান। এজন্য তিনি বহুমুখী অংশীদারিত্বে অর্থায়নের একটি ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। যাতে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর লস অ্যান্ড ডেমেজ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর এই ঘটনা উন্নত দেশগুলোকে বিচেনায় নিতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে আজকের দিনে জলবাযু অভিবাসন একটি নিয়মিত ঘটনা। সেটিকে বিবেচনায় নিয়েই সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এই অভিবাসন মানব সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের পৃথিবীতে ওলটপালট করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিবাসন ও স্থানান্তর উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।
জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করা আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসির নব্বই দশকের একটি সতর্কবার্তা উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইপিসিসি নব্বই দশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব হতে পারে মানুষের অভিবাসন। সংস্থাটির বর্তমান গবেষণায় তা প্রতিফলিত হচ্ছে। বিরূপ আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে বাস্তুচ্যুতি বেড়ে চলেছে।
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি বিষয়ক অপর এক বৈশ্বিক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ১৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে। এরমধ্যে চার কোটি মানুষই হবে দক্ষিণ এশিয়ার। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু হবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ।
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমরা প্রতিদিনই বৈশ্বিক গণমাধ্যমে শিরোনাম দেখি, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে মানুষ তাদের প্রিয় আবাসস্থল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের অর্থবহ বৈশ্বিক সহযোগিতা ও প্রতিশ্রুতির অভাবে পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটছে এবং আগামী দিনগুলোতে আরও অবনতি ঘটবে। নারী শিশু যুবক ও বয়োজ্যেষ্ঠরা এক্ষেত্রে সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ ভুক্তভোগী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে কম দায়ী এই দেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ মাত্র দশমকি ছয় টন। অথচ বিশ্বের গড় মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে ৪.৫ টন। উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের দায় আমাদের বহন করতে হচ্ছে।

আমাদের দেশে ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে অনিয়মিত বৃষ্টি, হঠাৎ বন্যা ও খরা, মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, সমুদ্রে এসিডের মাত্রা বৃদ্ধির মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা। আমাদের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ২০ শতাংই বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছর বাংলাদেশের সাড়ে ৬ লাখ মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে
আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের ২০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। এতে ওই অঞ্চলের ২ থেকে ৩ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। তখন আমাদের মানুষরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এতে বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।
ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ তাদের বাসস্থান হারাতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন বতমানে নগরে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে ১৩৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। মিয়ানমারের ১২ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মানুষকে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে ঠাঁই দেওয়ায় অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশের ওই উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের শহরগুলোতে প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় উঠে এসেছে হিট ওয়েভের কারণে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত শহর। বাংলাদেশ সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, সীমিত সম্পদ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য। ইতোমধ্যে সরকার ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান অনুমোদন করেছে। বাধ্যতামূলক বাস্তুচ্যুতিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলবায়ু সহিষ্ণু শহর এবং কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলবাযু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর লস অ্যান্ড ডেমেজের প্রতি উন্নত দেশগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠার কোন অগ্রগতি নেই। পর্যাপ্ত তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা আমাদের জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাই জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তাৎক্ষণিক চাহিদা উন্নত দেশগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে আজকের দিনে জলবায়ু অভিবাসন একটি নিয়মিত ঘটনা। সেটিকে বিবেচনায় নিয়েই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এই অভিবাসন মানব সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে দায়িত্ব আদান প্রদানের গ্লোবাল মেকানিজমই হতে পারে একমাত্র সমাধান।
জলবাযু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আমাদের আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারি এবং সহজে কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারি।
বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) যৌথভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ সাইড ইভেন্টের আয়োজন করে।
এই ইভেন্টে আরও বক্তব্য রাখেন ঘানার সিভিএফ চেয়ারপারসনের বিশেষ দূত হেনরি ইকোকোফু, আইওএম এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মিস উগুচি ড্যানিয়েলস। এ সময় মেয়র মাইগ্রেশন কাউন্সিলের বোর্ড সদস্য এবং সিয়েরা লিয়নের ফ্রিটাউন মেয়র মিস ইউভুনি আকিসইয়ারের ভিডিও বার্তা শোনান হয়।