২৭ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার, ০৩:৩৯:০১ অপরাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে শ্লীলতাহানীর অপরাধে বোস্টন আ.লীগ নেতার ২ বছরের কারাদন্ড
ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১১-২০২২
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে শ্লীলতাহানীর অপরাধে বোস্টন আ.লীগ নেতার ২ বছরের কারাদন্ড যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে শ্লীলতাহানীর অপরাধে বোস্টন আ.লীগ নেতার ২ বছরের কারাদন্ড


যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে গালাগালি সহযোগে দৈহিক আক্রমণ ও শ্লীলতাহানীর অভিযোগে বোস্টনে আওয়ামীলীগ নেতা আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু (৬২-কে দুই বছরের কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) সকালে সালেম সিটি’র সুপিরিয়র কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক টমাস ড্রেচসলার এ রায় ঘোষনা করেন। চারটি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ২ বছরের কারাদন্ডসহ 'যৌন অপরাধী বা লম্পটের' তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিরও আদেশ দেওয়া হয়। উভয় পক্ষের আইনিজীবীসহ প্রচুর সংখ্যক বোস্টন প্রবাসী বাংলাদেশি রায় ঘোষনার সময় আদলতে উপস্থিত ছিলেন। এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বাংলা প্রেস।

আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু'র (মামলা নম্বর ২০৭৭সিআর০০৩১০) বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে গালাগালি সহযোগে দৈহিক আক্রমণ ও শ্লীলতাহানীসহ চারটি অভিযোগ আনা হয়েছিলো। এরমধ্যে ২টি অভিযোগ- ২৬৫/১৩এইচ-৩ এ/বি ধারায় ১৪ বছর বা তার বেশি ব্যক্তির উপর অশালীন আক্রমণের অপরাধে, ২৬৫/১৩এ/বি-১ এ/বি সি২৬৫/১৩এ (এ) (অপকর্মের জন্য ১০০ দিনের বেশি কারাবাস) প্রমাণিত হয়েছে। বাকি ২টি অভিযোগ ২৬৫/২২/এ-১ 'ধর্ষণ' এবং ২৬৫/১৫ ডি/এ-শুন্য 'শ্বাসরোধ' প্রমাণিত না হওয়ার উক্ত ২ অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ধরণের চরিত্রহীন ব্যক্তি কিভাবে বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন)-এর সভাপতি হিসেবে কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এ বিষয়টিও উঠে আসে দুই আইনজীবির যুক্তিতর্কে। রায় ঘোষনার সময় আদালত কক্ষে তিন সারি বোস্টন প্রবাসী বাংলাদেশি (সকলেই চট্টগ্রামবাসী) উপস্থিত ছিলেন।   দন্ডপ্রাপ্ত আসিফ বাবুর দেশের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়তলীর থানার কাটতলী গ্রামে।    

গত ১৪ অক্টোবর বিজ্ঞ বিচারক টমাস ড্রেচসলার তার বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে গালাগালি সহযোগে দৈহিক আক্রমণ ও শ্লীলতাহানীর অভিযোগের জামিন প্রত্যাহার করে মুলতবি দণ্ডাদেশে আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু (৬২)-কে জেল হাজতে পাঠান। আটক বোস্টন আওয়ামীলীগের এ নেতাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন বোস্টন প্রবাসী কিছু বাংলাদেশি (চট্টগ্রামবাসী)। তার সাজা কমাতে আদালতে সুপারিশপত্র পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি পরিচালনাধীন মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির পক্ষে কতিপয় কর্মকর্তা।

নিউ ইংল্যান্ডের বোস্টন ভিত্তিক বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন) এর সভাপতি থাকাকালীন সময়ে উক্ত ঘটনাটি ঘটলেও তা ধামাচাপা দিয়ে এবং হাজার হাজার প্রবাসীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি দিব্যি বেইন-এর সভাপতি হিসেবে কর্মকান্ড চালিয়েছেন যা সংগঠনের সংবিধান পরিপন্থী ছিলো বলে অনেকেই উল্লেখ করেন।

আসিফ বাবু বোস্টন সংলগ্ন মেডফোর্ডের বাসিন্দা। বোস্টনে দু’গ্রুপে বিভিক্ত নিউ ইংল্যান্ড (বোস্টন) আওয়ামীলীগ (ইউসুফ-ইকবাল) গ্রুপের বর্তমান সহ-সভাপতি। আওয়ামীলীগের সাথে পূর্বে তার কোন সম্পর্ক না থাকলে নিউ ইংল্যান্ড (বোস্টন) আওয়ামীলীগে তাকে অন্তর্ভূক্তি করেন (ইউসুফ-ইকবাল) গ্রুপের সাবেক সাধারন সম্পাদক ইকবাল ইউসুফ (সাবেক শিবিরকর্মী)। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন)-এর সাবেক সভাপতি, নিউইংল্যান্ড (বোস্টন) স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং নারী সংগঠন নন্দিনী'র নিউ ইংল্যান্ড শাখার সাবেক সভাপতি। ইতিপূর্বেও তার বিরুদ্ধে অনেক শ্লীলতাহানীর অভিযোগ উঠেছিল। কয়েক বছর গায়ে হাত দেবার অপরাধে প্রকাশ্য জনসম্মুখে তাকে থাপ্পর মেরেছিল তার নিজের মামী শ্বাশুড়ি। কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে প্রথম আটকের পর তার স্ত্রীও তাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল বলে জানা গেছে।  

আদালতে আসিফ বাবু'র গুরুদন্ড কমিয়ে লঘুদন্ড বা 'কমিউনিটি সার্ভিস' এর একটি আবেদনপত্রে সাধারন মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এটর্নী জেনারেল ও সিনেটরের কাছে শতাধিক সাধারন মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বোস্টনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কথিত নামধারী কিছু কমিউনিটি নেতা। এরা হলেন আওয়ামীলীগের সাবেক কর্মী আবু কামাল আজাদ (বার টেন্ডার), মুদি দোকান ব্যবসায়ী হুমায়ুন মোর্শেদ, শাহীন খান, নিউ ইংল্যান্ড বুড্ডিষ্ট সংগঠনের নেতা তপন চৌধুরী ও বেইনের বর্তমান সভাপতি পারভীন চৌধুরী (আসিফ বাবুর স্ত্রী)সহ বেশ কিছু ব্যবসায়ী।  

কমিউনিটির কথিত নামধারী কমিউনিটির নেতারা সাধারন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাকে সমর্থনে প্রবাসীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করায় বোস্টনে বাংলাদেশিদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আসিফ বাবু'র এমন কর্মকান্ডে লজ্জিত হয়ে পড়েছেন নিউ ইংল্যান্ড (বোস্টন) আওয়ামীলীগসহ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাও। দুই সপ্তাহ আগে তার গ্রেফতার ও মামলার রায় ঘোষনার পর নিউ ইংল্যান্ড আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ইউসুফ চৌধুরী, অপর গ্রুপের সাবেক সভাপতি ওসমান গণি'র সাথে ফোনে কথা হলে তারা এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। এছাড়াও সাবেক সাধারন সম্পাদক ইকবাল ইউসুফ ও সুহাস বড়ুয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদেরকে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তারা কোন উত্তর দেননি।    

মামলার বিবরণে জানা যায়, আসিফ বাবুকে সালেম সিটি’র একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর উপর গালাগালি সহযোগে দৈহিক আক্রমণ ও শ্লীলতাহানীর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তিনি দুই বছর আগে ভাড়ার জন্য একটি রুম সম্পর্কে তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। সালেম সুপিরিয়র কোর্টের জুরি দ্বারা আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু ধর্ষণসহ আরও গুরুতর অভিযোগের পাশাপাশি শ্বাসরোধের অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছিলেন। এক সপ্তাহব্যাপী বিচারের পর শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) বিচারক টমাস ড্রেচসলার চৌধুরীর জামিন প্রত্যাহার করে এবং মুলতুবি দণ্ডাদেশে তাকে হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। আগামী মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) আসিফ বাবুকে তার কৃতকর্মের জন্য আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হবে।

কৃষ্ণাঙ্গ ঐ নারী সালেমের ফেডারেল স্ট্রিটে জরুরী আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন মহামারীর কারণে চাকরি হারানোর পরে ভাড়া দিতে অক্ষম হয়েছিলেন।

তার তৎকালীন ৯ বছর বয়সী মেয়ের সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাকালীন সময় তিনি মেডফোর্ডে থাকার জন্য একটি বাসার অনুসন্ধান করেছিলেন যাতে তার মেয়ে উচ্ছেদের আগে যে স্কুলে পড়াশোনা করেছিল সেখানে ফিরে যেতে পারেন। প্রসিকিউটর কেট ম্যাকডুগালের জিজ্ঞাসাবাদে এ সাক্ষ্য দিয়েছেন ঐ নারী।

তিনি বিচারকদের বলেন, একটি একক রুমে থাকার জন্য তার সামর্থ্য ছিল। তিনি আসিফ বাবুর ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে বাসা ভাড়ার একটি বিজ্ঞাপনে দেখে সাড়া দেন এবং রুমটি নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

কিছু দিন পরে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে আসিফ বাবু সালেমের ওই মহিলার সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে তিনি একটি ভাড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারেন। ওই বৈঠকের সময় উক্ত নারীর উপর অশ্লীল আক্রণ ও হামলার ঘটনাটি ঘটে বলে সাক্ষ্য দেন তিনি।

মহিলার ৯ বছর বয়সী মেয়ে বিচারকদের বলেন যে তিনি ‘অনেক বিশৃঙ্খলার’ শব্দে জেগে উঠেন এবং শোবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেন আসিফ বাবু তার মায়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কিছুতেই উঠতে পারেননি। মেয়েটি বিচারকদের বলেন সে বেডরুমে ফিরে এসে পুলিশের জরুরি নম্বর ৯১১ ফোন করেন।

প্রতিরক্ষা আইনজীবী সিরি ফ্রাইড এবং বেঞ্জামিন ব্রুকস পুলিশের কাছে মহিলার অ্যাকাউন্টের অসঙ্গতি, গ্র্যান্ড জুরির কাছে তার সাক্ষ্য এবং বিচারের সময় তার সাক্ষ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাকে ফেসবুক মেসেঞ্জার এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে প্রশ্ন দিয়ে চাপ দিয়েছিলেন যেখানে আসিফ বাবু হার্ট ইমোজি ব্যবহার করেছিলেন এবং তার প্রশংসা করেন।

তারা আরও পরামর্শ দিয়েছেন যে মহিলাটি ভাড়া দেওয়ার পরিমাণ নিয়ে বিরোধের সময় লড়াই শুরু করেছিল। ‘আপনি রেগে গিয়ে তাকে আঘাত করেছেন’, ফ্রাইড এমন একটি প্রশ্ন করলে মহিলাটি না উত্তর দেন।

ফ্রাইড মহিলাটিকে আসিফ বাবুর একটি ছবি দেখান যার ঘাড়ে আঁচড় রয়েছে এবং সেই রাতে তিনি যে ছেঁড়া শার্টটি পরেছিলেন। 'আমি তাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম বলে জবাব দেন ওই নারী।

সালেম পুলিশ অফিসার জোনাথন স্প্রিংগার প্রথম আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছান এবং দরজার কাছে আসিফ বাবুর মহিলার সাথে ঝগড়া দেখতে পান। তিনি দুজনকে আলাদা করেন।

অফিসার কিগান স্টোকস ঘটনাস্থলে পৌঁছেই মহিলার সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন যে ঐ সময় মহিলাটি উন্মাদভাবে কাঁদছিলেন। স্টোকস বিচারকদের বলেন যে তিনি লক্ষ্য করেছেন যে আশ্রয়ের অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘরটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল এবং মেঝেতে আসিফ বাবুর চশমা দেখতে পান।

উল্লখ্যে, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বোস্টনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন)-এর দ্বিবার্ষিক নির্বাচন চলাকালীন একটি প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী আসিফ বাবু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অপর প্যানেলের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের এক প্রার্থীকে প্রহার করলে সে গুরুতর আহত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ভোট বন্ধ করে দেয়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে খোকা-নবী-সামি পরিষদের ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থী এসএম সাজ্জাদ হোসেন স্থানীয় পুলিশের কাছে আসিফ বাবুর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এর কয়েক সপ্তাহ পরে বোস্টনের কয়েকজন কথিত কমিউনিটির নেতাদের হস্তক্ষেপে মামলাটি মিমাংসা করা হয়। ঐ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আসিফ বাবু নির্বাচনের কমিশ্নের সাথে যোগসাজস করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন)-এর দুই বছর মেয়াদী সভাপতি নির্বাচিত হন। চলতি বছরে একই কায়দায় তার স্ত্রী পারভীন চৌধুরীকে তিনি ‘বেইন’-এর সভাপতি পদে বসিয়েছেন। বোস্টনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এ নিয়ে এখনো চলছে নানা গুঞ্জন।