আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউর সঙ্গে সম্পর্কের ৪৯তম বছর প্রায় শেষ হওয়ার পথে। দীর্ঘ এ সময়ে ঢাকা-ইইউ সম্পর্ক এখনও ২১ বছর আগের করা সহযোগিতা-চুক্তির মধ্যেই আটকে আছে। তবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পরিবর্তন, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের পরিধি বহুমাত্রিকতায় নিতে আগ্রহ বাড়ছে ইইউর।
ঢাকাও চাইছে সহযোগিতা-চুক্তির পর্যায় থেকে সম্পর্ককে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে। তারই ধারাবাহিকতায় পারস্পরিক রাজনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে উভয়পক্ষের সম্মতিতে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংলাপে বসছে ঢাকা-ইইউ। আগামী ২৯ নভেম্বর ঢাকায় হতে যাচ্ছে এ সংলাপ।
সংলাপে উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। এর বাইরে বৈশ্বিক সমসাময়িক পরিস্থিতি, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যু। এ ছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, কানেক্টিভিটি, রোহিঙ্গা ইস্যু, নিরাপত্তা, অবৈধ অভিবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোও আলোচনার টেবিলে থাকতে পারে
সংলাপে উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। এর বাইরে বৈশ্বিক সমসাময়িক পরিস্থিতি, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যু। এ ছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, কানেক্টিভিটি, রোহিঙ্গা ইস্যু, নিরাপত্তা, অবৈধ অভিবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোও আলোচনার টেবিলে থাকতে পারে।
ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা রয়েছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। অন্যদিকে ইইউর পক্ষে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এনরিকে মোরা নেতৃত্ব দেবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইইউর সঙ্গে শুধুমাত্র উন্নয়ন আর বাণিজ্যে আটকে থাকতে চায় না ঢাকা। তাছাড়া ঢাকার সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহ রয়েছে ইইউর। রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানো নিয়েও আগ্রহী তারা। সেজন্য উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ হতে যাচ্ছে। এটি ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সংলাপ। উভয়পক্ষ কীভাবে আরও কাজ করতে পারে বা সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়, সেজন্যই রাজনৈতিক সংলাপ।
আমরা তো চাচ্ছি ইইউর সঙ্গে সম্পর্কটাকে আরেকটু গভীর করতে। নতুন কলেবর দিতে। আমরা শুধুমাত্র উন্নয়ন আর বাণিজ্যের মধ্যে আটকে থাকতে চাই না। ২০০১ সালে ইইউর সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছিল, সেটার আলোকে চলছে। এটাকে আরেকটু পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ানাম প্রকাশ না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তো চাচ্ছি ইইউর সঙ্গে সম্পর্কটাকে আরেকটু গভীর করতে। নতুন কলেবর দিতে। আমরা শুধুমাত্র উন্নয়ন আর বাণিজ্যের মধ্যে আটকে থাকতে চাই না। ২০০১ সালে ইইউর সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছিল, সেটার আলোকে চলছে। এটাকে আরেকটু পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
সংলাপে আলোচনার টেবিলে কোনো বিষয়গুলো থাকতে পারে— জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, এটা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। দেখা যাক তারা কী চায়। তবে বলা যেতে পারে, যেহেতু এটা রাজনৈতিক সংলাপ; এখানে রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ হবে। উভয়ের সম্পর্ক কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই হলো মূল লক্ষ্য। তাছাড়া সমসাময়িক পরিস্থিতি, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু, যোগাযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা ইস্যু থাকতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবরের শেষ প্রান্তে ব্রাসেলসে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে ইইউর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এনরিকে মোরার বৈঠকে চলতি বছরে রাজনৈতিক সংলাপের সিদ্ধান্ত হয়। পরে গত ২৮ জুন ঢাকায় সংলাপের তারিখ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইইউর কারণে সংলাপটি হয়নি।
সংলাপে ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতি তুলবে ইইউ। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও আলোচনা করতে চাইবে তারা। এছাড়া উভয়ের সম্পর্কের পর্যালোচনা বিশেষ করে, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রোহিঙ্গা সমস্যা, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সংলাপে ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতি তুলবে ইইউ। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও আলোচনা করতে চাইবে তারা। এছাড়া উভয়ের সম্পর্কের পর্যালোচনা বিশেষ করে, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রোহিঙ্গা সমস্যা, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।
চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ও ইইউর যৌথ কমিশনের দশম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান
সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে নিতে আরও সময় প্রয়োজন
২০০১ সালে ইইউর সঙ্গে সহযোগিতা-চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তিতে অর্থনীতি, উন্নয়ন, সুশাসন কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। তবে সময়ের আবর্তে বর্তমান বাংলাদেশে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ইইউরও। তারা ভূ-রাজনীতি, নিরাপত্তা ইস্যু তথা ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো বিষয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায়। বাংলাদেশও ইইউর সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে নিতে আগ্রহী।
তবে এখনই সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। আর সে পর্যন্ত সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।
কৌশলগত সম্পর্কে ওরা (ইইউ) এখনই রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না। সময় নেবে তারা। এলডিসির সঙ্গে কৌশলগত ব্যাপারটা ইইউর নীতিগত অবস্থান কি না, তা আমরা জানি না। যতদিন আমরা কাগজে-কলমে এলডিসি আছি ওই নামটা হয়তো দেবে না। আমরা নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কথা বলছি। ওই আলোচনা হবে। আমরা তুলে যাব। হয়তো তারা ২০২৬-এর আগে কৌশলগত সম্পর্কের ট্যাগটা দিতে রাজি হবে নাপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কৌশলগত সম্পর্কে ওরা (ইইউ) এখনই রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না। সময় নেবে তারা। এলডিসির সঙ্গে কৌশলগত ব্যাপারটা ইইউর নীতিগত অবস্থান কি না, তা আমরা জানি না। যতদিন আমরা কাগজে-কলমে এলডিসি আছি ওই নামটা হয়তো দেবে না। আমরা নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কথা বলছি। ওই আলোচনা হবে। আমরা তুলে যাব। হয়তো তারা ২০২৬-এর আগে কৌশলগত সম্পর্কের ট্যাগটা দিতে রাজি হবে না।
ইইউ তাদের ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশকে পাশে চায়। বাংলাদেশও ইইউর আইপিএসে যোগ দিতে বাধা দেখছে না। কেননা, ইইউর আইপিএসে যেসব বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে আদর্শিকভাবে মিল রয়েছে।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের বার্তা স্পষ্ট। যদি কোনো সামরিক বিষয় না থাকে, আমরা আলোচনা করতে পারি বা সামনে এগোতে পারি। ইইউর অনেক দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে চায়।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক
ইইউর সঙ্গে প্রায় ৫০ বছরের সম্পর্ক। বিশেষ করে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইইউ জোটের কিছু দেশের বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বেসরকারি সম্পৃক্ততা বেশ শক্তিশালী। পাশাপাশি গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে
ইইউর সঙ্গে প্রায় ৫০ বছরের সম্পর্ক। বিশেষ করে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইইউ জোটের কিছু দেশের বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বেসরকারি সম্পৃক্ততা বেশ শক্তিশালী। পাশাপাশি গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যদি ইইউ জোটের দেশগুলোর কথা চিন্তা করি, জার্মানি বা ব্রিটেনের বিনিয়োগ সম্পর্ক এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। ইইউর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বা উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, বিশেষ করে আমাদের নন-গভর্নমেন্টাল সেক্টরে ওরা অনেক শক্তিশালী। সেই অর্থেও ইইউ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ বা বেসরকারি অংশগ্রহণ যেটা দেখি সেটা অনেক বেশি শক্তিশালী।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউর একটা অবস্থান আছে। তারা সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। কিন্তু এখানে ইইউ একমাত্র স্টেকহোল্ডার না। চীন-ভারতের ভূমিকাটা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকাও পালন করছে। তবে এখানে রাশিয়াকে হিসাবে ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পোলাইরাইজেশন রয়েছেঅধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ নিয়ে ইইউর আগ্রহের যথেষ্ট কারণ আছে জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপকের ভাষ্য, ইইউর পররাষ্ট্র নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। সামগ্রিকভাবে তাদের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো। এগুলো তাদের কাছে বড় বিষয়। যার ফলে বাংলাদেশের এখনকার যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেই বিবেচনায় ইইউর আগ্রহের যথেষ্ট কারণও আছে। এটাও সত্যি যে এখন সেই আকাঙ্ক্ষার জায়গায় তাদের মেম্বার স্টেট ব্রিটেন ও জার্মানি বাংলাদেশের নির্বাচন বা সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ আগ্রহী। সেই দিক বিবেচনায় জোটের কিছু সদস্য রাষ্ট্রেওর সঙ্গে সম্পর্কে কিছু টানাপোড়নও আছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউর ভূমিকা নিয়ে তানজিম উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউর একটা অবস্থান আছে। তারা সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। কিন্তু এখানে ইইউ একমাত্র স্টেকহোল্ডার না। চীন-ভারতের ভূমিকাটা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকাও পালন করছে। তবে এখানে রাশিয়াকে হিসাবে ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পোলাইরাইজেশন রয়েছে।