২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ০২:৩৬:২০ অপরাহ্ন


চীনের দুশ্চিন্তা বাড়াল ভারতের রণতরী বিক্রান্ত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২২
চীনের দুশ্চিন্তা বাড়াল ভারতের রণতরী বিক্রান্ত ফাইল ফটো


উদ্বোধন হলো ভারতের নিজস্বপ্রযুক্তিতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরী বা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্তের। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যের কোচিনে উদ্বোধন হয় অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজটির। ৪৫ হাজার টন ওজনের জাহাজটি নির্মাণে মোট খরচ ২৩ হাজার কোটি রুপি বা ২৯০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্সের মতো মাত্র অল্প কয়েকটি দেশেরই সক্ষমতা রয়েছে নিজস্ব বিমানবাহী রণতরী বানানোর। এবার সেই এলিট লিস্টে প্রবেশ করলো ভারতও। সে হিসেবে বিক্রান্তের উদ্বোধন ভারতের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

সব ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ভারতের মাটিতে তৈরির দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে আরও গতিশীল করবে আইএনএস বিক্রান্ত।

এ ছাড়া ভারত মহাসাগরীয় ও ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের সামরিক সক্ষমতাও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেবে এই যুদ্ধজাহাজ। বিশেষ করে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা চীনা নৌ সক্ষমতার বিরুদ্ধে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে আইএনএস বিক্রান্ত। ভারতের অপর বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে মিলিত ভাবে আইএনএস বিক্রান্ত চীনের নৌবাহিনীর মোকাবিলায় সমান সমান পাল্লা দিতে পারবে।

২৬২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৬২ মিটার প্রস্থের আইএনএস বিক্রান্ত ভারতে নির্মিত সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ। বিশালকৃতি ও বিপুল সংখ্যক নাবিক বহনে সক্ষমতার জন্য একে তুলনা করা যায় ছোটখাট একটি শহরের সাথেই। আইএনএস বিক্রান্তের ডেকের আয়তনই দুটি ফুটবল স্টেডিয়ামের সমান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা একটি ১৮ তলা ভবনের সমান।

বিমানবাহী রণতরীটি তার বিশাল হ্যাংগারে একসঙ্গে জায়গা করে নিতে পারে ৩০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার। ট্যাংক, কামান, যানবাহনসহ অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামও বহন করতে পারে এটি। সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্তে আছে নাবিকদের চিকিৎসারও সব ধরনের ব্যবস্থা। রয়েছে ১৬ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণ কাজ চলার পর গত বছরের আগস্ট থেকে শুরু হয় এর সি ট্রায়াল। বিক্রান্তের ৭৬ শতাংশ যন্ত্রাংশ ভারতের মাটিতেই তৈরি হয়েছে। এর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল ৫০০টি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান।


ভারতের অন্যান্য বিমানবাহী রণতরী

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নৌশক্তি ভারতের নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরী পরিচালনার ইতিহাস অনেক পুরনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ম্যাজেস্টিক ক্লাস বিমানবাহী রণতরী এইচএমএস হারকিউলেসকে কিনে নেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। ১৯৬১ সালে আইএনএস বিক্রান্ত নামে ভারতীয় নৌবাহিনীতে কমিশন্ড হয় জাহাজটি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে জাহাজটি অবসর দেয়া হয়। এ জাহাজটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনীর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত ঐতিহাসিক এ জাহাজটির স্মরণেই ভারতীয় নৌবাহিনীর সর্বশেষ সংযোজিত এ অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরীর নাম রাখা হয়েছে বিক্রান্ত।

এ ছাড়া আইএনস বিরাট নামেও আরও একটি বিমানবাহী রণতরী ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর। ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে এইচএমএস হারমেস নামে কমিশন্ড হওয়া জাহাজটিকে ১৯৮৭ সালে কিনে নিয়ে নিজেদের বহরে আইএনএস বিরাট নামকরণ করে ভারতীয় নৌবাহিনী। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হয়ে ফকল্যান্ড যুদ্ধে কমান্ড সেন্টার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ জাহাজ। ২০১৭ সালে অবসরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপের ভূমিকা পালন করে এই আইএনএস বিরাট।

অপর জাহাজ আইএনএস বিক্রমাদিত্য ২০১৩ সালে যুক্ত হয় ভারতীয় নৌবাহিনীতে। এটি মূলত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কিয়েভ ক্লাস বিমানবাহী রণতরী অ্যাডমিরাল গোর্শকভ নামে ১৯৮৭ সালে যোগ দেয় সোভিয়েত নৌবাহিনীতে। ১৯৯৬ সালে রাশিয়ান নৌবাহিনী থেকে জাহাজটিকে অবসরে পাঠায়। ২০০৪ সালে জাহাজটিকে কিনে নিয়ে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে আইএনএস বিক্রমাদিত্য নামে কমিশন্ড করে ভারতীয় নৌবাহিনী।

১৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে আইএনএস বিক্রান্ত

আইএনএস বিক্রান্ত জাহাজটিতে ১ হাজার ৪৪৯ জন নাবিক ও ১৯৬ জন অফিসার রয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক নাবিকের খাওয়াদাওয়ার জন্য বিক্রান্তের বাবুর্চিখানা বা কিচেনকেও ব্যস্ত থাকতে হয় রাতদিন। সেখানে রুটি তৈরির এমন মেশিন আছে যা দিয়ে ঘণ্টায় ৩ হাজার চাপাতি রুটি তৈরি করা যায়। জাহাজটিতে মোট তিনটি গ্যালি বা ডাইনিং হল রয়েছে। যেখানে এক সঙ্গে বসে খাবার খেতে পারেন ৬০০ নাবিক।

যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারগুলোর ওঠানামার জন্য জাহাজটিতে রয়েছে সাড়ে ১২ হাজার বর্গমিটারের সুবিশাল ডেক। এটি দুটি ফুটবল স্টেডিয়াম কিংবা আড়াইটি হকি স্টেডিয়ামের সমান। এই ডেক থেকে একই সঙ্গে ১২টি যুদ্ধবিমান ও ছয়টি হেলিকপ্টার ওঠানামা করতে পারে।

জাহাজটি চালায় জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির তৈরি চারটি গ্যাস টারবাইন। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ৩০ নটিক্যাল মাইল বা ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার। একবার রসদ পূর্ণ করে যাত্রায় বের হলে জাহাজটি ৮ হাজার নটিক্যাল মাইল বা ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।

বিক্রান্তে রয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

জাহাজটিতে রয়েছে ইসরায়েলের তৈরিক বারাক এইট বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যার রেঞ্জ একশ’ কিলোমিটার। জাহাজটিতে ২৬টি মিগ ২৯ কে মাল্টিরোল ফাইটার এবং দুটি কামোভ কে এ থার্টি ওয়ান হেলিকপ্টার, একটি সিকোরস্কি এমএইচ সিক্সটি হেলিকপ্টার ও একটি হাল ধ্রুব হেলিকপ্টার রয়েছে। এর হ্যাংগার থেকে ডেকে বিমান ওঠানামার জন্য রয়েছে দুটি লিফট। জাহাজটিতে থাকা অসংখ্য করিডোরের দৈর্ঘ্য একসঙ্গে করলে এর দৈর্ঘ্য হবে ৮ কিলোমিটার।

চীনের হুমকি মোকাবেলায় ভারতের ভরসা বিক্রান্ত

যদিও বিক্রান্ত যোগ হওয়ায় ভারতের হাতে এখন দুটি বিমানবাহী রণতরী। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে চীনা নৌবাহিনীর মোকাবিলায় কমপক্ষে তিনটি বিমানবাহী রণতরীর প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরেন ভারতের বেশ কয়েক সাবেক নৌ-প্রধান। তবে বিক্রান্তের সংযোজন নিঃসন্দেহে চীনা নৌবাহিনীর মোকাবিলায় আরও আরও আত্মবিশ্বাস যোগাবে ভারতের নৌসেনাদের।

আএনএস বিক্রান্ত নির্মাণে যুক্ত ভারতের নৌ কর্মকর্তা সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল একে চাওলা সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, চীনের মোকাবিলায় নৌশক্তি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই ভারতের সামনে। কারণ বিমানবাহী রণতরী নির্মাণে ভারতের তুলনায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে চীন। তবে বিক্রান্তের হাত ধরে ভারত মূল ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে গিয়েও আক্রমণ করার এবং শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে মত দেন এই নৌ কর্মকর্তা।