২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৬:৫১:৩১ অপরাহ্ন


প্রলোভন-ভয়ভীতি দেখিয়ে তিন বছর ধরে শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার ছাত্রী
স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৭-২০২২
প্রলোভন-ভয়ভীতি দেখিয়ে তিন বছর ধরে শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার ছাত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী যৌন লালসার শিকারের পৈশাচিক চিত্র তুলে ধরেন।


রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাটুপাড়া কারিগরি ও বাণিজ্যিক ইনস্টিটিউটের ‘ড্রেস মেকিং এন্ড টেইলারিং’ ট্রেড এক শিক্ষক একই ট্রেডের এক ছাত্রীকে নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে দিনের পর দিন ধর্ষণ ও নির্যাতন করে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুক্রবার (২৯ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী শিক্ষক মাসুদ হোসেন সরকারের এমন যৌন লালসার শিকারের পৈশাচিক চিত্র তুলে ধরেন। শুধু ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীই নন; নানা প্রলোভনের টোপ ফেলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও ৮-১০ অসহায় ছাত্রীকে এমন স্বর্বশান্তের চেষ্টা করেন লম্পট ওই শিক্ষক। ভুক্তভোগী ছাত্রী সংবাদ সম্মেলনে নিজেসহ ৮-১০ জন ছাত্রীর সঙ্গে ওই শিক্ষকের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের চেষ্টার কথপোকথনের রেকর্ড উপস্থাপন করেন। অভিযুক্ত শিক্ষক উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের বাটুপাড়া গ্রামের মৃত সিদ্দিক সরকারের ছেলে এবং ওই ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ আরজেদ হোসেন সরকারের চাচাতো ভাই। 

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘২০১৯ জানুয়ারিতে আমি বাটুপাড়া কারিগরি ও বাণিজ্যিক ইনস্টিটিউটের ‘ড্রেস মেকিং এন্ড টেইলারিং’ গ্রুপ এ ভর্তি হই। এর আগে আমার জীবনের নানা উত্থান-পতন এবং বেশকিছু করুণ কাহিনী ঘটে গেছে। তাই স্থির করেছিলাম, কারিগরি থেকে পড়ালেখা করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের ‘ড্রেস মেকিং এন্ড টেইলারিং’ ট্রেড এর শিক্ষক মাসুদের যৌন লালশার শিকার হয়ে আমার কষ্টের এই জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে।’

যৌন লালসার শিকারের শিকারের ইতিহাস তুলে ধরে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘শিক্ষক মাসুদের বাড়ির পাশেই (দুই মিনিটের দূরত্ব) আমাদের বাড়ি। সেই সুবাদে আমার পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই মাসুদের একটা সখ্যতা ছিলো। আমি ওই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষক মাসুদ প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতো। আমাদের বাড়িতে একটি দুধাল গাভী ছিলো। ২০১৯ সালের ১০ মে বিকালে শিক্ষক মাসুদ (সম্পর্কে চাচা) আমাকে তার বাসায় দুধ দিয়ে আসতে ফোন করেন। সরল বিশ^াসে সন্ধ্যার দিকে আমি তার বাড়িতে দুধ দিতে যাই। ওই সময় তার বাড়িতে কেউ ছিলো না। আমি তার বাড়িতে গেলে আমাকে তার ঘরে দুধ দিয়ে যেতে বলেন। ফাঁকা বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগে আমি ঘরে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। তার মুখে এমন কথা শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু তার রোষানল থেকে আমি রক্ষা পাইনি। ওইদিনই আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের বিষয়টি বাড়িতে বললে সে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে রাখার কথা বলে। এমনকি ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ে বিষয়টি প্রথমে পরিবারকে জানাইনি। এভাবেই আমার সঙ্গে জোরপূর্বক তার বিকৃত যৌনাচার চলছিলো। 

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘দিনের পর দিন তার ধর্ষণ-অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমি ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস্ এ চাকরি করা শুরু করি। কিন্তু সেখানে গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। আমার মামাতো বোনের নিটক থেকে ঠিকানা নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর বিকালে গাজীপুরে এসে আমাকে ফোন দিয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও জন্ম তারিখ, নাম-ঠিকানা সংশোধনের জন্য দেখা করতে বলে। এমনকি ধর্ষণের ভিডিও ফোন থেকে ডিলিট করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। আমি আবারো সরল বিশ^াসে তার সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু জানতাম না যে, সে আগে থেকেই কক্সবাজারের যাওয়ার টিকিট কেটে রেখেছিল। শিক্ষা অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে একটি বাসে তুলে নিয়ে আমাকে কক্সবাজার যায়। আমি যখন বুঝতে পারলাম আমাকে ‘ব্লাকমেইলিং’ করে কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই নিয়ে তার সাথে আমার প্রচ- রাগারাগি হয়। আমি কক্সবাজারের কোনো পথ-ঘাট চিনি না। রাগারাগির এক পর্যায়ে সে বলে, আমার সাথে তিন দিন হোটেলে থাকলে পূর্বের ভিডিও ডিলিট করে দেবো। পাশাপাশি সে আমার সাথে কোনোদিন যৌনাচারে লিপ্ত হবে বলে ওয়াদা করে। একপর্যায়ে কক্সবাজারের একটি হোটেল তার সঙ্গে থাকতে বাধ্য হই। সেখানে প্রতিদিনই জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। বাড়িতে চলে আসার দিনও পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনুযায়ী সে ধর্ষণের ভিডিও ডিলিট করবে না বলে জানায়। পরে তার নিকট থেকে ফোন জোরপূর্বক নিয়ে ধর্ষণের ভিডিও ডিলিট করি। ভেবেছিলাম- তার যৌন লালসা থেকে হয়তো মুক্তি পাবো। এজন্য বাড়ি এসে আবারো পড়ালেখা শুরু করি। ১৫ দিন যেতে না যেতেই শিক্ষক মাসুদ আবারো নানাভাবে উত্যক্ত শুরু করে। ধর্ষণের কুপ্রস্তাব দিয়ে পূর্বের ভিডিও অন্য কোথাও রেখে দেয়ার কথা বলে। আবারো সে পূর্বের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমাদের বাড়ির একটি গুরুকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। এছাড়া জমিতে পানি দেয়ার মোটরের পাইপ পরপর ৪ দিন ভেঙ্গে ফেলে। শেষের দিন তাকে আমরা হাতে-নাতে আটক করি। এছাড়া দেড় বিঘা জমির পোটলের গাছ কেটে নষ্ট করে এবং আমাদের একটি মোটর ভ্যান গাড়ি চুরি করে। কিন্তু তারপরেও ভয়ে কিছুই বলিনি। এর কিছুদিন পর রাতের অন্ধকারে আমার রুমে ঢুকে আমাকে আবারো জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। বাবা-মা বাইরে কাজে গেলেই সেই সুযোগে প্রায় ৪-৫ দিন আমাকে বাড়িতে একা পেয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এরপর ২০২১ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে হঠাৎ ফোন করে বলে মাসে ৩ বার তাকে ধর্ষণ করতে না দিলে এসএসসি পরীক্ষায় ফেলসহ নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। এমন ভয়ভীতি এবং জোরপূর্বক ধর্ষণ করার অডিও রেকর্ড আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। পরে ২০২১ সালে আমি এসএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু একটি বিষয়ে (ড্রেস মেকিং এন্ড টেইলারিং) বিষয়ে আমাকে ফেল করিয়ে দেয়। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি আমাকে ধর্ষণের ভিডিওসহ যত রকমের ডকুমেন্ট আছে সব মুছে ফেলার কথা বলে কৌশলে রাজশাহী শহরে নিয়ে আসে। সেদিন জোরপূর্বক নগরীর নওদাপাড়া বাসটার্মিনালের কাছে স্টার হোটেলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। কিন্তু ধর্ষণের ভিডিও ডিলিট না করায় রাগ করে বাসায় চলে যাই। এভাবে দিনের পর দিন ধর্ষণের ভিডিও ফাঁসের ভয় দেখিয়ে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। তার অত্যাচার সইতে না পেরে তার মোবাইল নম্বর, ফেসবুক আইডি ব্লক দিয়ে যোগাযেগ বন্ধ করে দেই। সর্বশেষ ৮ জুন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আমবাগানের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন মাসুদ তার দূর সম্পর্কেও এক আত্মীয়ের বাড়ির দরজায় ওঁৎ পেতে থেকে আমার হাত থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। আমি ফোন নেয়ার জন্য ঘরের দরজায় গেলে জোরপূর্বক ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। তখন আত্মচিৎকারে আমার ভাতিজা দৌঁড়ে এসে উদ্ধার করে। এরপর মাসুদ তার বাড়িতে গিয়ে তার ভাই-ভাতিজা, স্ত্রী, মেয়ে, ভাবিসহ সবাই এসে আমাকেসহ বাবা-মাকে পিটিয়ে আহত করে। আহত অবস্থায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাত দেড়টার দিকে রামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়ে চার দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরি। এই ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) দারস্থ এমনকি কলেজের অধ্যক্ষের নিকট বিচার চেয়েও পাইনি। বাধ্য হয়ে গত মাসে রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত-২ এ মামলা করেছি। তাই প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমার ওপর একজন শিক্ষকের ধর্ষণ, ব্যভিচার-অত্যাচারের বিচার চাই।’ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রী বলেন, ‘আমাকেও একইভাবে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার কথা বলে কুপ্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমি রাজি না হওয়ায় সে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ওই শিক্ষক শুধু ছাত্রীকেই নয়; এলাকার দুইজন বিবাহিত মহিলাকেও একইভাবে ফুঁসলিয়ে ধর্ষণ করেছে এবং লম্পট শিক্ষক নিজেই বিবাহিত ওই দুই মহিলার বাচ্চাকে নিজের সন্তান বলেও দাবি করেছে। আমরা গরীব-অসহায় বলে আমাদেরকে এভাবে হেনস্তা করছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

অভিযুক্ত শিক্ষক মাসুদ হোসেন সরকারের নিকট মুঠোফোনে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেই ফোন কেটে দেয়। তারপর শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অসংখ্যবার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

এ ব্যাপারে জানতে বাটুপাড়া কারিগরি ও বাণিজ্যিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ আরজেদ হোসেন সরকারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। 

মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সানওয়ার হোসেন বলেন, ‘ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী আমার কাছে এসেছিলো। দিনের পর দিন ব্লাকমেইলিং করে তাকে যে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন বেশ কিছু অডিও রেকর্ড ও ছবি আমাকে দিয়েছে। কিন্তু এগুলো যেহেতু ক্রিমিনাল কেইস। তাই ভুক্তভোগীকে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করতে বলেছি। হয়তো সে ন্যয়বিচার পাবে।’ সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। 

রাজশাহীর সময়/এম