চোখ মেলে তাকালে চারিদিকে কেবলই সবুজ আর সবুজ। এ যেন বিশাল এক সবুজেরই সমারোহ। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে নানান রকমের ফসল। ফল ও ফসলে সবুজ প্রকৃতি আবৃত হয়ে থাকলেও এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা। একটা ইটভাটা পেরোলেই চোখে পড়বে আরেকটি ইটভাটা। এসব ইটভাটা থেকে কু-লি পাকিয়ে উড়ছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া!
রাজশাহীর পাবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের, খড়খড়ি বাইপাস সড়ক ধরে কুখ-ী, হাজরাপুকুর, পুড়াপুকুর, রামচন্দ্রপুর ও তেবাড়িয়া হয়ে পারিলা হাট পর্যন্ত গেলে দেখা যাবে একের পর এক ইটভাটা গড়ে উঠেছে এই এলাকায়। দেশের প্রচলিত আইন ও সব রকমের নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে এসব ইটভাটা। বাংলা পঞ্জিকায় থাকা বর্ষাকাল বাদ দিয়ে পুরো মৌসুমজুড়েই চালু থাকে এসব ইটভাটা।
এই ইটভাটাগুলোর অধিকাংশেরই যেমন পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। তেমনি এগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও তেমন বড় ধরনের নজির নেই। অনুমতিবিহীন এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় তাই মরছে কৃষি; মরছে প্রকৃতি। ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে ওঠায় পরিবেশ দূষণসহ ফসলের ফলন কমে যাচ্ছে। ক্রমেই সবুজ প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে উঠছে। আর তামাটে বর্ণ ধারণ করছে ফসলি জমির মাটি। এভাবে একটা সময় আসছে যখন ফসলি জমির উর্বরতা হারাচ্ছে।
এরপর সেই জমির ওপরের স্তর চলে যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। এতে জমির উর্বরা শক্তি আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। আর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ফল ও ফসলে। কোনো কোনো ইটভাটায় দিনে কয়লা পোড়ানো হলেও রাতে পুড়ছে কাঠ। আশপাশের বনভূমিও উজার হয়ে যাচ্ছে। আর যারা কয়লা পোড়াচ্ছেন তারাও খুবই নিম্নমানের কয়লা পোড়াচ্ছেন। এতে হিতে বিপরীতই হচ্ছে। নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোয় বায়ুদূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর মূল্যবান সম্পদ আমসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল উৎপাদনও হুমকিতে পড়েছে। আমের ভরা মৌসুমে গাছের আমে কালচে দাগ পড়ছে।
আমের সময়ে গাছ থেকে মুকুল ও আম ঝরে যাচ্ছে। মিষ্ট ফলও বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সেই ফল আর কেউ মুখে দিতে পারছেন না। মরিচের গাছ আছে, ফুল ফুটছে না। টমেটো লাগালে বড় হচ্ছে না। ফুল আসার পরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান পেঁয়াজের চারা। এভাবে বিভিন্ন ফসলহানী ছাড়াও স্থানীয়রা ভুগছেন শ্বাসকষ্টে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকিতে পড়ছেন লাখ লাখ মানুষ।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়কারী এসব ইটভাটা থেকে বিষাক্ত কলো ধোঁয়ার সঙ্গে সুক্ষকণার নির্গত ছাই আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সাধারণত ছাই ও বস্তুকণা গাছের পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দেয়। এতে উদ্ভিদের স্বাভাবিক সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। কার্বন-ডাই অক্রাইড ও সালফার-ডাই অক্রাইড মিশ্রিত ছাই আম, লিচু, কাঁঠাল, ধান, শিম, কুমড়া, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের রেণুকে ধ্বংস করে দেয়। এতে ফসলের উৎপাদনও মারাত্মকভাবে কমে যায়। আর ইটভাটার ইট বানাতে টপ সয়েল পোড়ানোয় মাটির উর্বরতা শক্তিও কমে যায়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, দুই বা তিন ফসলী জমিতে বা এর পাশে ইটভাটা করা যাবে না। আর এক ফসলি জমিতে ইটভাটা করতে হলেও সেই চৌহদ্দির প্রতিবেদন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে জমা দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীরা তা করেন না। আর আইনগতভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে আভিযানিক ক্ষমতা নেই। এটা জেলা প্রশাসন দেখে থাকে। তবে, তারা বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কারণ ইটভাটার কারণে প্রতিবছর কয়েক’শ বিঘা ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। এসব জমিতে যত দিন পোড়া মাটি থাকবে, তত দিন ফসল হবে না। বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসল ও ফলের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
এদিকে, রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে- এই জেলায় বর্তমানে ইটভাটা রয়েছে ১৩৬টি। এসবের মধ্যে রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলায় ২১টি, পবা উপজেলায় ৪৬টি, পুঠিয়া উপজেলায় ১৪টি, চারঘাট উপজেলায় সাতটি, বাঘা উপজেলায় দুইটি, মোহনপুর উপজেলায় ছয়টি, দুর্গাপুর উপজেলায় ১০টি, তানোর উপজেলায় দুইটি ও বাগমারা উপজেলায় ২৮টি। আর এই ১৩৬টির মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ৩৯টির। এছাড়া রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে ইট পোড়ানোর লাইসেন্স নিয়েছে মাত্র ১০টি ইটভাটা। বাকিগুলোর লাইসেন্সই নেই। আবার যাদের লাইসেন্স আছে তাদের কেউ কেউ আবার নানান অজুহাতে সেই লাইসেন্সও নবায়ন করেননি।
অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে লাইসেন্স ছাড়া কোনোভাবেই ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না বলে আইন ও নীতিমালা রয়েছে। প্রতিটি ইটভাটায় সর্বোচ্চ ২ একর জমি ব্যবহারের কথা থাকলেও ভাটা মালিকরা আরও বেশি জমি ব্যবহার করছেন। দুই বা তিন ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছেন না ভাটা মালিকরা। এছাড়া ফসলি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করেই সেই মাটি পুড়িয়েই তৈরি করা হচ্ছে ইট। এতে ভাটার পাশে সৃষ্টি হচ্ছে গভীর জলাশয়। এর ফলে ধীরে ধীরে হাজার হাজার বিঘা জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে। ইট প্রস্তুতকরণ ও ভাটা স্থাপনসংক্রান্ত ২০১৩ সালের আইনে অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া ইটভাটা স্থাপন ও ইট পোড়ানো সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। এ আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে এক বছরের কারাদ- অথবা অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু রাজশাহীতে এ আইন লঙ্ঘন করেই বেশিরভাগ ইটভাটায় ইট বানানো ও পোড়ানোর কাজ চলছে।
রাজশাহী ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি সভাপতি সদরুল ইসলাম বলেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, ‘কেবল ধোঁয়ায় ফসল ও ফলের ক্ষতি হয় এই কথা সঠিক নয়। অনেক কারণেই ক্ষতি হতে পারে। ভাটার পাশেও আমের ভালো ফলন হচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। তাই একতরফাভাবে ইটভাটাকে দায়ী করা ঠিক না। আর ইটভাটার লাইসেন্স পেতে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রথমে ছাড়পত্র নিতে হয়। এই ছাড়পত্র নেওয়ার পর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আবেদন করতে হয়। যা দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। কারণ আইনগত জটিলতার কারণে অনেক সময় পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া যায় না। পেলেও লাইসেন্স পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এছাড়া জেলা প্রশাসক দপ্তরের হিসেবে ১৩৬টি ইটভাটা থাকলেও বাস্তবে তা ১২০টি হবে। নানান কারণে অনেক ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। যা তাদের হিসেবে হালনাগাদ নেই। এর মধ্যে প্রায় ৩০টি ইটভাটার লাইসেন্স আছে। ছাড়পত্র পেলেও লাইসেন্স পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এজন্য লাইসেন্সের সংখ্যা এত কম বলেও দাবি করেন ইটভাটা সমিতির এই নেতা। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কল্যাণ চৌধুরী বলেন, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে রাজশাহী জেলা প্রশাসন বরাবরই সোচ্চার। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আসছে।
এই গত দুইদিন আগেও রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় পরিবেশ দূষণকারী তিনটি চিমনি ইটভাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে আপাতত জোরেশোরে অভিযান শুরু করা না গেলেও পর্যায়ক্রমে সব উপজেলাগুলোতেই অভিযান চলবে এবং ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
এরই মধ্যে রাজশাহী জেলা প্রশাসক ভ্রাম্যামাণ আদালত জোরদার করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহীর এই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।