২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৩:১৪:২২ অপরাহ্ন


ইতেকাফের বিধান ও উপকারিতা
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৪-২০২২
ইতেকাফের বিধান ও উপকারিতা ফাইল ফটো


রোজাদারের ইবাদতের প্রতিযোগিতার নাম ইতেকাফ। ইতেকাফে বসে রোজাদার দিনের সিয়াম ও রাতের কিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বাহুল কাঙ্ক্ষিত লাইলাতুল কদর চায়। স্বয়ং নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফে বসে গভীর ইবাদত-বন্দেগিতে লেগে যেতেন। ইতেকাফ শুধু নবিজীর সুন্নাতই নয় বরং কোরআনুল কারিমেও ইতেকাফের বিধান ঘোষণা করা হয়েছে। আবার ইতেকাফের অনেক উপকারিতাও আছে। কী সেই বিধান ও উপকারিতা?

নবিজীর ইতেকাফ: ২০ রমজান ইফতারের আগে থেকে শুরু করে ঈদের চাঁদ না দেখা পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করে হলো মাসনুন ইতেকাফ। হাদিসে এসেছে-

'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতেন।' (বুখারি, মুসলিম)

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেহাদে অংশগ্রহণের কারণে এক রমজান ইতেকাফ করতে পারেননি। বরং তিনি পরবর্তী বছর ২০ দিন ইতেকাফ করে তা পূরণ করেছেন। এ ছাড়া তিনি কোনো রমজান ইতেকাফ ত্যাগ করেনি। হাদিসে এসেছে-

'রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজানে দশদিন ইতেকাফ করতেন। তবে ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফ করেছেন।' (বুখারি)

ইতেকাফের বিধান: ইতেকাফের মর্যাদা ও উপকারিতা অনেক বেশি। যুগে যুগে ইতেকাফের প্রচলন ছিল। ইবাদত-বন্দেগির জন্য ইতেকাফ আল্লাহর দেওয়া বিধানও বটে। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে ইতেকাফের বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-

وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ

‘আর স্মরণ কর, যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং (আদেশ দিলাম যে,) তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কর। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর। ’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৫)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত যে, ইতেকাফ আল্লাহর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। প্রথম তিনি কাবা শরিফকে তাওয়াফ, ইতেকাফ ও নামাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। । দ্বিতীয়ত কাবা শরিফে আগে তাওয়াফ আর পরে নামাজ পড়া হয়। তৃতীয়ত ফরজ হোক কিংবা নফল হোক কাবা শরিফের ভেতরে যে কোনো নামাজ আদায় করাই বৈধ।

এছাড়াও ইতেকাফের অন্যতম একটি বিধান হলো- কোনো ইতেকাফকারী স্বামী-স্ত্রী ইতেকফে বসলে মেলামেশা করতে পারবে না। এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا

আর যতক্ষণ তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন।' (বুখারি, মুসলিম)

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন এবং তাঁর স্ত্রীগণও তাঁর পরবর্তীতে ইতেকাফ করেছেন।' (বুখারি, মুসলিম)

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে যেমন কাবা শরিফ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার ইতেকাফে বসা স্বামী-স্ত্রীদের কেউ ইতেকাফের নির্ধারিত দিনগুলোতে মেলামেশা করতে পারবে না। এসবই মহান আল্লাহর বিধান। যাতে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে ইতেকাফ করতে পারে।

ইতেকাফের মর্যাদা: হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দেন-

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। অর্থাৎ আসমান ও জমিনের মাঝে যত দূরত্ব আছে তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ সুবহানাল্লাহ! (বায়হাকি)

রোজাদার ইতেকাফকারীর জন্য অনুমানের একটি বিষয় হলো- কোনো বান্দা যদি রমজানের শেষ দশদিনের মাসনুন ইতেকাফ যথাযথভাবে আদায় করে তবে আল্লাহ বান্দাকে কী পরিমাণ প্রতিদান দেবেন।

ইতেকাফের উপকারিতা: ১. লাইলাতুল কদর পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম ইতেকাফ। হাদিসে এসেছে-

'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের মাঝের দশদিন ইতেকাফ করতেন। একবছর এভাবে ইতেকাফ শেষ করার পর যখন রমজানের ২১তম রাত আসল (অর্থাৎ যে রাত শেষে সকালে তিনি ইতেকাফ থেকে বের হলেন) তখন তিনি ঘোষণা করলেন-

'যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতেকাফ করেছে সে যেন শেষ দশক ইতেকাফ করে। কারণ, আমাকে লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের ওমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে খোঁজ কর।’ (বুখারি)

২. ইতেকাফকারীর অবসর সময়ে কোনো আমল না করলেও তার দিনরাত ইবাদত হিসেবেই গণ্য হয়।

৩. ইতেকাফের উসিলায় অনেক পাপাচার ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। কেননা গোণাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর ঘর যেন একটি প্রকৃত দুর্গ।

৪. ইতেকাফ দ্বারা দুনিয়ার সব ঝামেলা ও সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। ঝামেলা ও সমস্যামুক্ত সময়ে নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহ তাআলার কাছে সঁপে দেয়া যায়। রোজার কারণে সারাদিন রোজা পালন ফেরেশতাদের সাথে মানুষের সামঞ্জস্য হয় এবং ফেরেশতাসূলভ আচরণের উপর অবিচল থাকার চমৎকার প্রশিক্ষণ হাসিল হয়।

৫. রোজার যাবতীয় আদব ও হক যথাযথ আদায় করে পরিপূর্ণ রোজা আদায় করার জন্য ইতেকাফ অত্যন্ত কার্যকর।

৬. আল্লাহ তাআলার মেহমান হয়ে তার সাথে মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম মসজিদে ইতেকাফ। এজন্যই সশ্রদ্ধভাবে একান্ত মনোবাসনা নিবেদনের জন্য ইতেকাফের বিকল্প ইবাদত দুনিয়াতে সত্যিই বিরল।

সর্বোপরি ইতেকাফকারী ব্যক্তি মসজিদে অবস্থান করার ফলে স্বাভাবিক সময়ের যে সব আমল করতে অক্ষম, সেসব আমলেরও সাওয়াব পায় ইতেকাফকারী। যেমন- জানাজায় শরিক হওয়া, অসুস্থদের সেবা করা ইত্যাদি আমল না করেও তার ছাওয়াবের অংশীদার হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে থাকে।

সুতরাং মুমিন মুসলমান রোজাদারের উচিত রমজানের শেষ দশ ইতেকাফে অংশগ্রহণ করা। কেনানা রমজানের ইতেকাফ পালন যেমন মহান আল্লাহর নির্দেশ আবার প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাসনুন ইবাদতও বটে। তাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যথাযথ নিরাপত্তার সঙ্গে ইতেকাফে অংশগহণও জরুরি।

উল্লেখ্য, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তার স্ত্রীগণ, সাহাবায়ে কেরামও ইতেকাফ অংশগ্রহণ করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরও এ ধারা অব্যহত থাকে। আজও বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে ইতেকাফ করে থাকেন। তাইতো ইতেকাফ একটি মর্যাদা ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাসনুন আমলা। যা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ হক আদায় করে ইতেকাফে অংশগ্রহণ করে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও ফজিলত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

রাজশাহীর সময়/এএইচ