খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু খুন হয়েছেন। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সিগাল পয়েন্টের ঝাউবনে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর থানার ওসি ইলিয়াছ খান।
কাউন্সিলর টিপু হত্যার ক্লু বের করার লক্ষ্যে খুলনার সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার ও কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার নুরুল কবির ভুট্টোকে হেফাজতে নিয়েছে র্যাব-১৫।
অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন নিহতের ভগ্নিপতি মো. ইউনুস আলী সেখ।
শুক্রবার দুপুরে নথিভুক্ত হওয়া মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ভিকটিম গোলাম রাব্বানী টিপুর (৫৫) কক্সবাজার জেলায় আগে চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা ছিল। ৮ জানুয়ারি রাত ১১টার গ্রিনলাইন বাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন টিপু। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে টিপুর সঙ্গে বোন হ্যাপির (বাদীর স্ত্রী) মোবাইলে যোগাযোগ হয় এবং কক্সবাজারে বেড়াতে আসার কথা জানায়। একই দিন রাত প্রায় ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুর থানা পুলিশের মাধ্যমে খবর পান টিপুকে কক্সবাজার পৌরসভার ১২নং ওয়ার্ডের সুগন্ধা পয়েন্টে হোটেল সিগালের পশ্চিম পার্শ্বে ফুটপাতের ওপরে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়।
তিনি আরও লেখেন, স্থানীয় লোকজন টিপুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মৃত ঘোষণা করেন। কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতের পর মরদেহ মর্গে পাঠায়। শুক্রবার সকালে বাদী ও পরিবারের লোকজন মর্গে উপস্থিত হয়ে লাশ শনাক্ত ও হত্যার বিষয়ে স্থানীয় লোকজনদের কাছে বিস্তারিত জানতে পারেন। আমাদের ধারণা, ৯ জানুয়ারি রাত অনুমান সোয়া ৮টা হতে সাড়ে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে টিপুকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে।
নিহত গোলাম রব্বানী টিপু (৫৫) খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা উত্তরপাড়ার বাসিন্দা গোলাম কবিরের ছেলে। তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতির পদে ছিলেন।
ঘটনার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে হত্যার আলামত সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। নিহত টিপুর সঙ্গে তার সহকর্মী সাবেক এক কাউন্সিলর কক্সবাজার এসেছেন এবং তারা একসঙ্গে একটি হোটেলে যান বলে জানতে পারেন তারা। এরপর র্যাব-১৫-এর সদস্যরা সেই কাউন্সিলর ও কক্সবাজারে টিপুর কাছের জন হিসাবে পরিচিত এক যুবককে হেফাজতে নিয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। তাদের সঙ্গে খুলনার এক নারী শিক্ষার্থীও এসেছেন এমনটি প্রচার পাওয়ায় তার অবস্থান নিশ্চিতের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনটি জানিয়েছে জেলা পুলিশের সূত্র।
টিপুকে রক্তাক্ত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া অটোরিকশাচালক জানান, রাত পৌনে ৯টার দিকে সৈকতের সিগাল পয়েন্টের কাঠের সাঁকোর পাশের ঝাউবনে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। অকস্মাৎ হওয়া এ আওয়াজ গুলির বুঝতে পেরে অনেকে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। তারা দেখতে পান এক ব্যক্তিকে গুলি করে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওই সময় গুলিবিদ্ধের চিৎকার শুনে এগিয়ে যান তিনি। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন লোক মোটরসাইকেলে এসে তাকে কপালে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পর্যাপ্ত আলো না থাকায় গুলি করে পালিয়ে যাওয়াদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয় বলে মনে হচ্ছে। আমরা তদন্ত করছি। এদিকে বিকালে ময়নাতদন্তের পর মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেন ওসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়িক কাজে প্রায় কক্সবাজারে অবস্থান করতেন টিপু। মহেশখালীর বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে শেয়ারে লবণ চাষ ও চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা করতেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কে জমিও ছিল তার। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে টিপুর বেশ সখ্য ছিল। কক্সবাজারে এলে অবস্থান করতেন ঝাউতলার হোটেল সাগরগাঁওয়ে।
তবে সাগরগাঁও হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, এক সময় তিনি নিয়মিত সাগরগাঁও হোটেলে থাকতেন। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে আর থাকছেন না।
স্থানীয়দের মতে, মাথায় যেভাবে গুলি করা হয়েছে তাতে অনুমান করা যাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে তাকে সৈকতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রব্বানী, ইফতেখার এবং রুমি নামে এক নারী একইসঙ্গে কলাতলীর হোটেল গোল্ডেন হিলে কক্ষ বুক করেন বলে প্রচার পায়। তবে তারা একসঙ্গে হোটেলে উঠেননি। কক্ষ বুকিংয়ের সময় ‘রব্বানী’ (গোলাম রব্বানী টিপু) তাদের তিনজনের পরিচয় দেন বলে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে মাস্ক পরা এক নারীকে রব্বানীর সঙ্গে হোটেল থেকে বের হতে দেখা যায়। রুমি খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী বলেও প্রচার পেয়েছে। ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রব্বানীর সঙ্গে বের হওয়া রুমি নামে ওই নারীকে খুঁজছে। হত্যার পর রাত ১টার দিকে র্যাব হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বলে জানা গেছে।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, সৈকতের বেলাভূমির তীর ঝাউবন এলাকা ও সড়কে পর্যাপ্ত আলো না থাকার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এর আগেও রাতের অন্ধকারে থাকা এসব এলাকায় অস্ত্র, মাদক হস্তান্তর, ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের জড়ো হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।