রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘন করে চার কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকা তছরুপ করার অভিযোগ উঠেছে। চাকরিতে বেতন-ভাতার বিধান ভঙ্গ করে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে লাঞ্চ ভাতার নামে এসব অর্থ ব্যয় দেখানো হয়।
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের এক অডিট প্রতিবেদনে এসব আর্থিক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে এত কিছুর পরও থেমে নেই কর্মকর্তাদের লাঞ্চ। এখনো নিয়মভঙ্গ করে লাঞ্চ করছেন কর্মকর্তারা।
অডিট প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দ্বিতীয় থেকে ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তারা দৈনিক উপস্থিতির জন্য ২০০ টাকা হারে লাঞ্চ ভাতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা আদেশ অনুযায়ী, শুধু ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা মাসিক ২০০ টাকা হারে টিফিন ভাতা পাবেন। তবে যেসব কর্মচারী লাঞ্চ ভাতা অথবা বিনামূল্যে দুপুরের খাবার পান তারা টিফিন ভাতা পাবেন না।
অথচ রাকাবের প্রধান কার্যালয়, স্থানীয় মুখ্য কার্যালয় রাজশাহীসহ এর আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নীলফামারী, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বীরগঞ্জ, রংপুর, মিঠাপুকুর, গাইবান্ধা এবং গোবিন্দগঞ্জ শাখা ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে অনিয়মিতভাবে কর্মকর্তাদের লাঞ্চ ভাতা দিয়ে আসছে। এটি চাকরি (ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ এর লঙ্ঘন। নিয়মবহির্ভূতভাবে লাঞ্চ বাবদ চার কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকা তছরুপ করা হয়েছে।
এদিকে অভিযোগের জবাবও আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে অডিট কমিটি। তাদের দাবি, অভিযোগের ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জবাবে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেতন ও ভাতার বিধানে লাঞ্চ ভাতার কথা বলা থাকলেও তা ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা পাবেন। ১০তম এবং তদূর্ধ্ব গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য লাঞ্চ ভাতা প্রয়োজ্য নয়।
গুরুতর এ আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান বরাবর অওজ জারি করা হয় এবং রাকাবের সচিবকে জানানো হয়। পরে একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তাগিদপত্র দেওয়া হয়। জবাব না পাওয়ায় ১ মার্চ রাকাবের প্রধান নির্বাহী বরাবর আধা সরকারি পত্র দেওয়া হলেও নিষ্পত্তিমূলক জবাব দেওয়া হয়নি।
এদিকে অডিট আপত্তির পরও এখনো লাঞ্চ ভাতা গ্রহণ করছেন রাকাবের কর্মকর্তারা। প্রতিদিনই অফিস থেকে ২০০ হাটা হারে লাঞ্চ ভাতা পাচ্ছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাকাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি না হলেও আমরা লাঞ্চ ভাতা পাচ্ছি। সব গ্রেডের কর্মকর্তাই লাঞ্চ ভাতা পাচ্ছেন। সব ব্যাংকেই এটি আছে। আমাদের ব্যাংকেও আছে। কমার্শিয়াল অডিট আপত্তিতে এটা উঠে এসেছিল। কিন্তু এরপরও এখন পর্যন্ত এটি চালু আছে।’
এ বিষয়ে রাকাবের এমডি নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘আমি ঢাকায় মিটিংয়ে আছি। এরকম একটা অডিট আপত্তি ছিল সেটা জানি। এটার বর্তমান আপডেট অফিস গেলে জেনে জানাতে পারবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই লাঞ্চের নিয়ম সব ব্যাংকেই আছে। এমনকী বাংলাদেশ ব্যাংকেও আছে। আমাদের এখানেও নিয়ম অনুযায়ী ভাতা গ্রহণ হয়েছিল। তবে এখন কী অবস্থা, সেটা বিস্তারিত জেনে জানাবো।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, “রাকাব এখন এখন ‘ভাতের হোটেলে’ পরিণত হয়েছে, যেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি ‘ভাতের হোটেল’। নয়তো তারা সোয়া চার কোটি টাকার লাঞ্চ খেতেন না।”
তিনি বলেন, রাকাব উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে শেষ করা হয়েছে। হুট করে তারা প্রতিষ্ঠানটিকে লাভবান দেখিয়েছেন। এটির মাধ্যমে বোঝা যায়, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্নীতি ও লুটপাট করে প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিয়ে রেখেছেন।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, কৃষকদের জন্য এই ব্যাংক শুরু হয়েছিল। কিন্তু কৃষকদের ঋণ না দিয়ে তারা বড় বড় ব্যাংকখেকোদের তেল মালিশ করতে থাকেন। এভাবেই তারা ব্যাংককে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা এত টাকার লাঞ্চ খেয়েছেন, অনতিবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাই।