২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:৩৫:৪৩ অপরাহ্ন


খাগড়াছড়িতে জমে উঠেছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসব
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৪-২০২২
খাগড়াছড়িতে জমে উঠেছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসব খাগড়াছড়িতে জমে উঠেছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসব


খাগড়াছড়িতে গতকাল রোববার থেকে শুরু হয়েছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব বৈসু। এ দিনটির জন্য পুরো বছর ধরে অপেক্ষা করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। দিনটিতে তারা এক স্থানে সমবেত হয়। সেখান হয় প্রাণের মেলবন্ধন। শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে ছোট বড় সবার মাঝে।

করোনার কারণে গত দুই বছর এই উৎসব মন ভরে উদযাপন করতে পারেনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এ সম্প্রদায়। এবার মন খুলে সব ধরনের আয়োজন করে আগের মতো উৎসবে মেতে উঠেছে তারা। ভবিষ্যতেও এমন আয়োজন অব্যাহত রাখার ইচ্ছা পোষণ করছে লোকজন।

রোববার (১০ এপ্রিল) ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন বৈসু উপলক্ষে সকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা মাঠে সমবেত হয়। সেখান থেকে আলোচনা সভা শেষে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের ব্যানারে একটি শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

উদ্বোধন শেষে শোভাযাত্রাটি উপজেলা মাঠ থেকে শহরের চেঙ্গী স্কয়ার ও শাপলা চত্বর ঘুরে টাউন হলে একটি গরয়া নৃত্যের মাধ্যমে শেষ হয়। পরে সবাই মিলে খাগড়াপুর গিয়ে সমবেত হন। সেখানে আয়োজন করা হয় নানা ঐতিহ্যবাহী খেলা।

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসু উৎসব উদযাপন করে তিন দিন। পুরোনো বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন। হারি বৈসু, বৈসুমা ও বছর কাতাল। সাধারণত চৈত্রের ৩০, ৩১ ও ১ বৈশাখ। এই তিন দিন বৈসু উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে।

তবে খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী দিনটি হওয়ার কথা ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল। কিন্তু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এখনো আগের অবিভক্ত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈসু উৎসব উদযাপন করে থাকে। ত্রিপুরারা অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে সব ধরনের উৎসব, পূজা, পার্বণ উদযাপন করে থাকে।

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসু। প্রতিবছর জুম চাষ শুরুর আগে তারা এ উৎসব উদযাপন করে থাকে। এ উৎসব অনেকটা জুম চাষকেন্দ্রিক। যেহেতু বৈশাখ মাস থেকে পুরোদমে জুম চাষের কাজ শুরু হয়, তাই বিরতিহীন জুমকাজে হাত দেওয়ার আগে ত্রিপুরারা বৈসু উৎসব উদযাপন করে থাকে।

ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরয়া নৃত্য ও সুকুই খেলার হিড়িক। তারা এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে মন খুলে ঐতিহ্যবাহী খেলার আয়োজন করে থাকে। এটির মাধ্যমে নিজেদের আনন্দ উপভোগ করে এই সম্প্রদায়ের ছোট-বড় সবাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম হলো ত্রিপুরা সম্প্রদায়। পার্বত্য অঞ্চলের খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ত্রিপুরাদের প্রধানতম সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসু। একে ঘিরে পাহাড়ে পাহাড়ে, পাড়ায় পাড়ায় তাদের ঐতিহ্যবাহী গরয়া নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। 

বৈসু শুরু হলে গরাইয়া নৃত্যের দল বেরিয়ে পড়ে। তারা পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিচরণ করে। ঘুরে ঘুরে পাহাড়ি ত্রিপুরা পল্লির বাড়িতে বাড়িতে পরিবেশিত হয় এই নৃত্য। তবে ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় এই নৃত্য ‘গরয়া’ মূলত ত্রিপুরাদের হলেও এখন অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই বৈসুতেও পাহাড়ের সব মানুষের কাছেই এখন আগ্রহের বিষয় গরয়া নাচ। ত্রিপুরা শিশুরা সুকুই বিচি দিয়ে খেলতে ভালোবাসে, যাকে তারা 'সুকুই থুংমুং' বলে। এটি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী খেলা। বৈসু এলে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতীসহ নানা বয়সের নারী-পুরুষরা এ খেলায় মেতে ওঠেন। যেটাকে চাকমা সম্প্রদায় গিলা হেলা বলে থাকে, মারমা সম্প্রদায় বলে খোঞ্যাং আকাজা।

ঐতিহ্যবাহী বৈসু সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা বিউটি রানী ত্রিপুরা বলেন, আমরা ছোট থেকে এই উৎসব পালন করে আসছি। আমাদের মা-বাবারা এমনভাবে উৎসব পালন করতেন। তবে দিন দিন তা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের প্রজন্মের মাঝে স্মরণীয় করে রাখতে এই খেলাধুলার আয়োজন করেছি। যাতে ভবিষ্যতে এমন ধর্মীয় কাজ অব্যাহত রাখতে পারে। ঐতিহ্যবাহী খেলা নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় শাপলা দেবি ত্রিপুরা বলেন, আমরা বৈসু উপলক্ষে গরয়া নৃত্যের আয়োজন করি। এটি আমাদের ত্রিপুরা জাতির জীবনযাত্রার ইতিহাস। এটির মাধ্যমে যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরয়া নৃত্য পরিবেশন করে, তারা যে বাড়ির উঠানে গিয়ে নাচবে। সে বাড়ির মালিকের সব সুখ-দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুন বছরের শান্তি কামনা করা হয় নাচের মাধ্যমে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এই ধর্মীয় উৎসব সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে আনন্দে মেতে উঠতে চাই। আমরা গত দুই বছর করোনার কারণে ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানগুলো করতে পারিনি। এবার সবাই মিলে প্রাণের মেলবন্ধনে একত্র হব। ত্রিপুরা জাতির যে ঐতিহ্য রয়েছে, তা আজ থেকে শুরু হয়েছে। এই উৎসবে সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হবে পাহাড়ি অঞ্চল। আনন্দ ভাগাভাগি করবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

রাজশাহীর সময় / এম আর