২৯ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০৮:৪৬:৪৩ অপরাহ্ন


রাজশাহী-১ আসনে পরিবর্তন চায় ভোটাররা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-১২-২০২৩
রাজশাহী-১ আসনে পরিবর্তন চায় ভোটাররা রাজশাহী-১ আসনে পরিবর্তন চায় ভোটাররা


রাজশাহীর ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত রাজশাহী। এই আসন থেকে তিনবার মন্ত্রী। হয়েছেন সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি টানা তিনবার এই আসন থেকে জয়লাভ করেছেন। তবে এবার এই আসন থেকে পরিবর্তন চাচ্ছেন সেখানকার ভোটাররা। এজন্য খুঁজছেন বিকল্প প্রার্থী। এই আসনে এবার সবচেয়ে বেশি ১১জন প্রার্থী ভোটে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। তবে কেউ ছাড় দিতে রাজি নয় ফারুক চৌধুরীকে।

এই দুই উপজেলার সাধারণ ভোটাররা আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছাড়া অন্য প্রার্থীদের সম্ভাবনা দেখছেন না। এ আসনে আছে চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে আলোচনায় আছেন চিত্রনায়িকা শারমিন আক্তার নিপা (মাহিয়া মাহি), তানোর উপজেলা সাবেক সভাপতি ও মু-মালা সাবেক পৌর মেয়র গোলাম রাব্বানী, আওয়ামী লীগের শিল্প বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আয়েশা আক্তার ডালিয়া ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান আক্তার।

তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে ব্যপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ চার প্রার্থীই বলছেনÑটানা ১৫ বছরে ওমর ফারুক চৌধুরী নানা বিতর্কিত কর্মকা- করেছেন। সেবক নয়, এলাকায় ‘শাসক’ হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর প্রতিবাদ হিসেবেই তারা ভোটের মাঠে এসেছেন। ভোটের মাঠে এসব অগ্নিঝরা বক্তব্য সবচেয়ে বেশি বলছেন মাহিয়া মাহি।

এই এলাকার ভোটাররা বলছেন, ওমর ফারুক চৌধুরী শুধু ক্ষমতায় থেকেছেন। এলাকার উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। তিনি তার পক্ষে কাজ করতে চাপও সৃষ্টি করছেন। এছাড়াও তার অনেক বিতর্কিত কর্মকা- আছে। তবে এবার এই আসনে পরিবর্তন হওয়া দরকার। এমন মানুষ ভোটে জিতে আসুক যেন তিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজ শিক্ষক বলেন, ফারুক চৌধুরী এই এলাকায় জমিদারদের মতো থাকেন। তিনি সাধারণ মানুষের কষ্ট বুঝেন না। সরকারি সব সহায়তা দিয়ে তিনি নিজের নামে প্রচার করেন। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও আছে। এছাড়াও তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোও অনিয়ম করে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে।

গোদাগাড়ী এলাকার বিজয়নগর গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, তিনি তিনবারের এমপি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাকে আমাদের এলাকায় একবারও দেখিনি। তিনি সবসময় তানোরে থাকেন। আমাদের কাছে আসেননি। আমাদের সমস্যাও শুনেননি। আমাদের গ্রামে আসেন তার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন সোহেল। তাকে কোনোদিন আমরা পায়নি।

তানোর উপজেলার কাশিমবাজার এলাকার ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম বলেন, এই বাজারে আমি দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করছি। এমপি ফারুক চৌধুরী কোনোদিন এই বাজারে নামেননি। তিনি এক কাপও চাও খেয়ে যাননি। ভোটের প্রচারণার ১০ দিন হয়ে গেল তাকে এখনও আসতে দেখিনি। কিন্তু অন্য প্রার্থীরা এই এলাকায় এসেছেন। শুধু ফারুক চৌধুরীর কর্মীরা প্রচার করে গেছেন। একজন এমপি হিসেবে অবশ্যই তার এলাকার জনগণের খোঁজখবর রাখার দরকার কিন্তু তিনি তা করেননি।

এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে সমালোচিত হন। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে রেষারেষি, নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে বসানো, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজের আত্মীয় ও অনুসারীদের মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্যতার খবরও মানুষের মুখে মুখে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ এর এক প্রতিবেদনেও মাদক-সংশ্লিষ্টতায় তার নাম এসেছে।

দুই উপজেলার বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলছেন, হয়তো এবার এই আসনে পরিবর্তন হতে পারে। ভোটাররাও আর চাচ্ছেন না এমপি ফারুক চৌধুরীকে। দলীয় মনোনয়ন পেলেও অনেকে সরে গেছেন তার কাছ থেকে। দীর্ঘ সময়ে ওমর ফারুক চৌধুরী যেমন জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তেমনি নিজস্ব কিছু কর্মী বাহিনীও তৈরি করেছেন। তাছাড়া তিনি তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে দুই উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন ভাতাভোগীদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন। নৌকায় ভোট দিলে এ ভাতা দ্বিগুণ হবেÑএমন কথা তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে ঢুকিয়েছেন। দুই উপজেলার সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সব সময়ই নিজের পক্ষে কাজে লাগান তিনি।

তবে এই এলাকার ভোটার ও রাজনৈতিক কর্মীরা বলছেন, চার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমঝোতা করতে হবে। নাহলে ভোট ভাগ হয়ে যাবে। আর এতে লাভবান হবে ফারুক চৌধুরী। তার আবারও বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফারুক চৌধুরীকে ঠেকাতে স্বতন্ত্র চার প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতার কথা ভাবছেন দলেরই কেউ কেউ। জেলা আওয়ামী লীগেরই এক নেতা এ উদ্যোগ নিচ্ছেন, এমন কথা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।

ভোটের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরীকে মুঠোফোনে ফোন দিলে তিনি ধরনেনি। তাই তার কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আয়েশা আক্তার ডালিয়া বলেন, আমি গোদাগাড়ীর মেয়ে। এখানকার আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছি। তানোর-গোদাগাড়ী উপজেলার মানুষের সুখ-দুঃখও বুঝি। তাদের কাছে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে চাই। তাদের মায়া-মমতা ও ভালোবাসার চাদরে ডেকে রাখবো। এজন্য আমাকে নির্বাচিত হতে হবে। এখানকার মানুষ আমাকেই চায়। আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।

আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। তিনি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাকে ধরা হচ্ছে শক্ত প্রতিদ্বন্দি হিসেবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের যা উন্নয়ন করেছে তা তানোর-গোদাগাড়ীবাসী বঞ্চিত। এখানকার এমপি ও তার শুধু বাহিনীর উন্নয়ন হয়েছে, সাধারণ মানুষের হয়নি। আমি এখানে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেয়র ছিলাম। লাঠিয়াল বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারলে যে ভোট পড়বে, তার ৭০ ভাগ আমি একাই পাবো।

চিত্রনায়িকা শারমিন আক্তার নিপা (মাহিয়া মাহি) আগে এ দুই উপজেলায় তেমন সক্রিয় ছিলেন না। শুধু নিজের নানার বাড়ি তানোরের মুন্ডুমালা এলাকায় কিছু সামাজিক কাজকর্ম করতেন। তবে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে ভোটের মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন। হাটে, ঘাটে, মাঠে থেকে শুরু করে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি পর্যন্ত যাচ্ছেন তিনি। সবখানে তিনি ‘চৌধুরীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে’ ভোট করছেন ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের সব সময় সম্মান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এছাড়া বছরের পর বছর বরেন্দ্র অঞ্চলে যে পানির সমস্যা, তা নিরসনের কথা বলছেন। ফলে যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই ভালো সাড়া পাচ্ছেন ঢাকাই সিনেমার এ চিত্রনায়িকা। এই কয়েক দিনের প্রচারেই ভোটের মাঠে তিনি অন্যতম প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছেন।

এ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান আক্তারও নিজের মতো করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনিও বর্তমান এমপি ফারুকের বিরোধী। তাকেও আসনটির শক্ত প্রতিদ্বন্দী ধরা হচ্ছে। আখতারুজ্জামান গোদাগাড়ীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত বছর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। দলীয় প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন মাত্র ৩২ ভোটে।

আখতারুজ্জামান বলেন, আমি ছাত্রজীবন থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। এখনও তাই করি। আমার এলাকার ভোটাররা খুবই ভালোবাসে আমাকে। তারা আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চাচ্ছে। আশাকরি আমি নির্বাচনে জয়লাভ করবো।

তবে কোনো প্রার্থীই নির্বাচনের প্রচারণায় বাধার মুখে পড়ছেন না বলে জানিয়েছেন। এক প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, আমি বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘুরেছি। একটি বিশেষ দলের প্রার্থীর কর্মিরা ভোটারদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ওই প্রতীকে ভোট না দিলে বাড়ির বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া হবে। সরকারি কোনো সুবিধা দেবে না। ভাতা বন্ধ করে দেবে। এছাড়াও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন আরেক নারী প্রার্থী নুরুন্নেসা। তিনি ন্যাশনাল পিপলস পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, নিজে নারী হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছি। ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য নারীদের বলছি। আশা করছি শতকরা ৯০ শতাংশ নারী ভোটকেন্দ্রে আসবেন ভোট দিতে। ভোটকেন্দ্রমুখী নারীরা এলে আমার জয় নিশ্চিত।

বিএনএফ প্রার্থী আল সাআদ বলেন, আমি দরিদ্র একটি পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। এই এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ জানি। প্রান্তিক পর্যায়ে গিয়ে কাজ করছি আমি। তাদের ভোট দেয়ার অনুরোধ করছি। ভোটাররাও আশ^াস দিচ্ছেন তারা ভোট দেবেন ।

তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অভিযোগ আছে মুক্তিজোটের প্রার্থী বশির আহমেদের। তিনি বলেন, প্রার্থী হিসেবে ২৫ লাখ টাকা খরচ করা যাবে। কিন্তু কিছু প্রার্থী কোটি টাকার উপরে খরচ করছেন। আমার নির্বাচনে বাজেট ২০ লাখ কিন্তু অন্য প্রার্থীর বাজেট আছে ২০ কোটি টাকা। তাহলে তো এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। প্রার্থীরা ভোটার প্রতি ১০ টাকা খরচ করার নির্দেশ থাকলেও তা অনেক প্রার্থী মানছেন না।

ভোটের মাঠে নেই তৃণমুল বিএনপির প্রার্থী জামাল খান দুদু। তিনি বলেন, বেশ কয়েকদিন থেকে আমি ঠা-া জ¦রে অসুস্থ হয়ে আছি। তাই এখন ঢাকায় অবস্থান করছি। এলাকায় প্রচারণা চলছে, সাথে মাইকিংও চলছে। সুস্থ হলে এলাকায় গিয়ে প্রচারণা চালাবো।

রাজশাহী-১ জাতীয় সংসদের ৫২ তম আসন। এ আসনের তানোর উপজেলায় পুরুষ ভোটার ৯০ হাজার ১৪৩ জন, আর নারী ভোটার ৯০ হাজার ৮৭০ জন। গোদাগাড়ী উপজেলায় পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৪ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৪৮ হাজার ২৭০ জন।