৩০ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৫:৫৫:৪৫ পূর্বাহ্ন


অপরিপক্ক টমেটোকে জোরপূর্বক পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে!
মঈন উদ্দীন:
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১২-২০২৩
অপরিপক্ক টমেটোকে জোরপূর্বক পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে! অপরিপক্ক টমেটোকে জোরপূর্বক পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে!


অপরিপক্ক টমেটোর ভেতর-বাইরের পুরোটাই সবুজ বর্ণের। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য জমি থেকে তোলার ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টমেটোকে জোপূর্বক সবুজ থেকে লালচে বর্ণ ধারণ করা হচেছ। দাম ভালো পাওয়ায় রাজশাহীতে হরহামেশাই অপরিপক্ব টমেটো ইথোফোন-রাইপেন দিয়ে এভাবেই পাকানো হচ্ছে। আর এসব টমেটো রাজশাহীর বাজার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকযোগে পাঠাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। আর এ টেমেটোতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরবে ভোক্তারা বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানে টমেটো প্রতি মণ ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চাহিদাও ভালো আছে। ‘কিছু দিন পর এই দাম আর দাম থাকবে না। তাই ছোট অবস্থায় টমেটো বিক্রি করছেন। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা শুধু জমি থেকে টমেটো কিনে খোলা মাঠে প্লাস্টিক-খড় পেতে রাখেন। এরপরে চুলে দেওয়া শ্যাম্পু স্প্রে করা হয় টমেটো পরিস্কারের জন্য। তারপরে রোদে রাখলে এমনিতেই টমেটোর কালার লাল হয়ে যায়। তারা টমেটোতে ক্ষতিকার হরমোন প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করলেও চাষিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা অধিক মুনফার জন্য হরমোন প্রয়োগ করে থাকেন। এছাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কথায় উঠে এসেছে হরমোন ব্যবহারের বিষয়টি।

জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার গোপালপুরের আশেপাশের এলাকায় এমন হরমোন ব্যবহার করতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। চাষিদের দাবি, এখন টমেটোর বাজার ও চাহিদা ভালো, বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগায় ব্যবসায়ীরা। তারা অপরিপক্ক টমেটো কৃষকের জমি থেকে তুলে নেয়। এরপরে একত্রিত করে ইথিলিন হরমোন স্প্রে করে। এতে করে টমেটো কাঁচা অবস্থায় পেকে যায়। পরে ব্যবসায়ীরা ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়।

টমেটোতে হরমোন প্রয়োগের বিষয়টি জানতে চাইলে ব্যবসায়ী শামসুল আলম বাবু জানান, তারা টমেটোতে শ্যাম্পু ছাড়া কিছু দেয় না। শ্যাম্পু দেওয়ার কারণে হিসেবে তিনি বলেন, জমিতে থাকা অবস্থায় টমেটোতে ময়লা-মাটি থাকে। শ্যাম্পু স্প্রে করলে ময়লা-মাটি ধুয়ে যায়। এতে করে টমেটোর সুন্দর রঙ আছে। এরপরে ধানের খড়ের ওপরে বিছিয়ে রোদে রাখলে এক থেকে দেড় দিন পর লাল রঙ চলে আসে। এখানে কোনো ওষুধ (হরমোন) ব্যবহার করা হয় না।

তবে কয়েকজন চাষি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি থেকে টমেটো তুলে খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়। ২৪ ঘণ্টায় দু’বার ইথোফোন বা রাইপেন ছিটানো হয়। এরপর তা শুকনো কাঁথা ও ধানের নাড়া বা কুটো দিয়ে জাগ দেওয়া হয়। এতে টমেটো দ্রুত লাল হয়ে যায়।

একজন চাষি বলেন, ‘টমেটো চাষে সুবিধা আছে। ব্যাবসায়ীরা জমির কাছে থেকে টমেটো কিনে নেয়। ফলে হাটে-বাজারে বিক্রির খরচ নেই। অনেক সময় টমেটো চাষের জন্য ব্যবসায়ীরা চাষিদের অগ্রিম টাকাও দিয়ে থাকে। আবার পুরো জমির টমেটো কিনে নেয় ব্যবসায়ীরা। টমেটো উঠার শুরু থেকেই ভালো দাম পাওয়া যায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘প্রতিদিন ৮-১০ ট্রাক টমেটো ঢাকা, কারওয়ান বাজার, চৌরাস্তা, সিলেট ও চট্টগ্রামে যায়। আমাদের জানা মতে, শনিবার ৮ ট্রাক টমেটো নিয়ে যাওয়া হয়েছে এসব এলাকা থেকে। তারা আরও বলেন, পাকা টমেটো পেতে এখনো এক মাস সময় লাগবে। তখন দাম আরও কমে যাবে। কাঁচা টমেটো কীভাবে পাকান? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন যেসব পাকা টমেটো দেখবেন সব ওষুধ দিয়ে পাকানো। তবে এই টমেটোতে তেমন স্বাদ নেই।’ 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবছর রাজশাহী জেলায় টমেটো চাষ হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে শুধু গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটোর চাষ হয়েছে ২ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে। যা উপজেলার হিসেবে সিংহভাগ গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটো চাষ হয়। গেল বছর (২০২২) মৌসুমে ৩ হাজার ১৫ হেক্টর ও ২০২১ সালে ২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হয়েছিল। তবে জেলায় মোট ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির মধ্যে গোদাগাড়ীর চাষাবাদ বাদ দিলে বাকি থাকা ২০০ হেক্টর সব উপজেলাগুলোতে টমেটোর চাষ হয়েছে।

গোদাগাড়ীর গোপালপুরের শ্রী বলরাম কর্মকার বলেন, চাষিরা বেশির ভাগ ৬৪২ প্রজাতির টমেটো চাষ করেছে। এছাড়া অনেকেই অন্য জাতের টমেটোও চাষ করেছে। তবে এবছর তুলনামূলক গাছে টমেটো কম। টমেটোর ভালো ফলন হয়নি। তবে এখনও দাম মোটামোটি ভালো আছে।   

গোদাগাড়ী উপজেলার এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘হরমোন দিয়ে টমেটো পাকানো হচ্ছে। এটা খেলে মানবদেহের ক্ষতি হবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এতে ক্ষতিকারক কিছু থাকে না, তারপরও কম মাত্রায় থাকতে পারে। এই হরমোন (ইথোফোন) কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করা হয়েছে। মূলত বেশি দাম পাওয়ার জন্য কাঁচা টমেটো বিক্রি করছেন চাষিরা।’

গোদাগাড়ী উপজেলার প্রোগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রাকিব জানায়, গেল প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে টমেটোর চাষ হচ্ছে। টমেটো চাষের পর বিক্রি করার সুবিধা রয়েছে। কৃষককে টমেটো হাঁটে নিয়ে যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরা জমি থেকেই টমেটো কিনে নেন। এতে অনেক টাকা ও সময় বাঁচে কৃষকের।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, রাজশাহী জেলার মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টমেটোর চাষ ও উৎপাদন হয়। তাই স্থানীয়ভাবে গোদাগাড়ীতে টমেটোর রাজ্য বলা হয়। সাধারণত আউশ ধান কেটে নেওয়ার পরে টমেটো চাষ শুরু হয়। এই উপজেলায় প্রায় ১৭ থেকে ২০ জাতের টমেটো চাষ হয়। যার মধ্যে বেশির ভাগ হাইব্রিড। তবে অন্য যেকোনো মাঠ ফসলের চেয়ে টমেটো চাষ অত্যন্ত লাভজনক।

এই উপজেলায় টমেটো কেনাবেচা হয় ১১০ কোটি টাকার বেশি। টমেটো বিক্রির সঙ্গে সরাসরি কৃষকরা জড়িত। ফলে কৃষকদের কাছে দিন দিন অর্থকরী ফসল হিসেবে রূপ নিয়েছে টমেটো। এছাড়া টমেটো কেনা-বেচাকে কেন্দ্র অস্থায়ীভাবে দুই থেকে আড়াই মাসের জন্য ৮ থেকে ৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। টমেটো জমিতে উৎপাদন। আর জমি থেকেই বিক্রি। বিক্রি ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় টমেটো চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

উৎপাদন আর দাম নির্ণয়ের বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, সাধারণত প্রতি হেক্টর জমিতে টমেটোর উৎপাদন ধরা হয় ২৫ মেট্রিক টন। সেই হিসেবে এবছর টমেটো উৎপাদন হচ্ছে ৫৬ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন। দামের হিসেবে টমেটোর গড় দাম মূল্য ধরা হয় ২০ টাকা কেজি দরে। এতে মোট দাম দাঁড়ায় ১১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এবছর ১১২ কোটি ২৫ লাখ টাকার টমেটো কেনা বেচা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

টমেটো পাকাতে হরমোন ব্যবহারের বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার মরিয়ম আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ব্যবসায়ীরা ইথিলিন হরমোন ব্যবহার করে টমেটো পাকানো জন্য। আমরা টেস্ট করে দেখেছি নর্মালি টমেটোতে এই হরমোন থাকে দশমিক ৯১ পিপিএম। তবে ২ পিপিএম পর্যন্ত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি নেই। আমরা হরমোন ব্যবহারের পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করি। তারপরও তারা (ব্যবসায়ীরা) ব্যবহার করে।