পরিবেশের ভারসাম্য ও জলাশয় রক্ষার লক্ষ্যে জলাধারভিত্তিক চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ এসব প্রকল্পে থাকবে বিনোদন কেন্দ্র, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আবাসনের সুযোগ ও জলাধারভিত্তিক নানা ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা। প্রতিটি প্রকল্পেই প্রায় ৭০ ভাগ এলাকা থাকবে জলাশয়।
রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা সমকালকে বলেন, রাজধানী থেকে খাল-জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান জলাশয়গুলোকে আধুনিকায়ন করে দৃষ্টিনন্দনভাবে রক্ষা করা রাজউকের একটি উদ্দেশ্য। এজন্য ওয়াটার বেজড (জলাধারভিত্তিক) প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই এ কাজ শুরু হবে। জলাশয়গুলো এখনই সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে এগুলোকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
রাজউকের এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনা পার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ও আশপাশের এলাকায়। শেখ রাসেল পার্ক হবে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এলাকায়। মতিঝিল পার্ক হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে থাকা জলাশয় ঘিরে। আর আশুলিয়ার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে আমিনবাজার থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর পর্যন্ত তুরাগ নদের পাড় ঘেঁষে ও আশুলিয়ায় ভরাট হয়ে যাওয়া বেসরকারি জমি অধিগ্রহণ করে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আশরাফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক ও আটটি বৃহৎ ইকো পার্কের প্রস্তাব রয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ড্যাপের প্রস্তাবেরও অগ্রগতি হবে।
বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, এটা আরও আগেই করার দরকার ছিল। আমাদের উদ্যোগের অভাবে রাজধানীর অনেক পুকুর হারিয়ে গেছে। এগুলো করলে রিটেইনশন পন্ডগুলো (জলাধার) রক্ষা পাবে। এজন্য সরকারের উদ্যোগ দরকার। শুধু এই চারটিই নয়, অন্য জলাশয়গুলোও যাতে দখল না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। রাজউকের তো সক্ষমতার ঘাটতি নেই। তারা সময়ভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে প্রথম পাঁচ বছরে কী করবে তা প্রকাশ করুক। তারপর ধাপে ধাপে কাজ এগিয়ে নিক। যত তাড়াতাড়ি করতে পারে ততই মঙ্গল। অনেক সময় দেখা যায়, কৃত্রিমভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। তবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রাকৃতিকভাবে করলেই ভালো হবে।
শেখ রাসেল পার্ক
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর মৌজায় ১৫ একর জমিতে তৈরি করা হবে শেখ রাসেল পার্ক। পার্কটি পুরোটাই হবে জলাধারভিত্তিক। রাইডগুলোও থাকবে জলাধারভিত্তিক। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪৮ কোটি টাকা। কেরানীগঞ্জ হাইওয়ের দু’পাশে প্রকল্পটি গড়ে উঠবে। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার, গাবতলী থেকে ৯ কিলোমিটার এবং সায়েদাবাদ থেকে ১৪ কিলোমিটার। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে।
এখানে জলাধারভিত্তিক নানা রাইড ছাড়াও থাকবে অ্যাম্ফিথিয়েটার, ওয়াকওয়ে, স্টিল ফুট ওভারব্রিজ, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে প্রভৃতি।
নারী ও পুরুষদের জন্য থাকবে পৃথক সুইমিং পুলের ব্যবস্থা। থাকবে ওপেন গ্রিন ফিল্ড ও চিলড্রেন প্লে গ্রাউন্ড। এজন্য কেরানীগঞ্জ মহাসড়কটি ২৫ ফুট থেকে ১০০ ফুট প্রশস্ত করা হবে। নতুন বছরের প্রথম দিকেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চায় রাজউক।
শেখ হাসিনা পার্ক
কেরানীগঞ্জের কাজিরগাঁও, শুভাঢ্যা, কুল্লিরচর, বাঘাইর, আতাসুর, আব্দুল্লাহপুর ও গোকপাড় মৌজায় বাস্তবায়িত হবে শেখ হাসিনা পার্ক। এজন্য ওই স্থানে থাকা খাস জমি ছাড়াও এ প্রকল্পের জন্য ৫৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ প্রকল্পে থাকবে আবাসিক প্লট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দেশি-বিদেশি পণ্যের শোরুম, খেলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। প্রকল্পটি এমনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে সেখানে কর্মরতদের আবাসনের ব্যবস্থাও ওই প্রকল্পে থাকবে। এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য ৩ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
মতিঝিল পার্ক
এ প্রকল্পে মোট জমির পরিমাণ ১১ দশমিক ৮৮ একর। এ জমির অবস্থান মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে। ওই জায়গার অনেকাংশে রয়েছে ডোবা প্রকৃতির জলাশয়। বাকি অংশ বিভিন্নভাবে অবৈধ দখলে আছে। এ জায়গা উদ্ধার করে দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজাতে চায় রাজউক।
মোট জমির ৭৫ শতাংশে থাকবে জলাশয়। বাকি অংশে তৈরি করা হবে ৬ হাজার ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের শিশুদের জন্য একটি পার্ক। পুরো জলাশয়ের ওপর থাকবে একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু। ৪০ ফুট প্রশস্ত সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে এক কিলোমিটারেরও বেশি। চারপাশে থাকবে ওয়াকওয়ে। ৮ ফুট প্রশস্ত ওয়াকওয়েটি হবে প্রায় আড়াই কিলোমিটার। এখানে থাকবে প্রাচীন ঢাকার ঐতিহ্য সংবলিত একটি স্থিরচিত্রের গ্যালারি ও আটতলাবিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। পুরো এলাকায় থাকবে দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ ও ল্যান্ডস্কেপিং।
আশুলিয়া আবাসন প্রকল্প
অন্যদিকে আমিনবাজার ব্রিজের উত্তরে কোর্টবাড়ি মৌজা ও পশ্চিমে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল থেকে উত্তর দিকে আশুলিয়া পর্যন্ত তুরাগের দু’পাশ দিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর পর্যন্ত এলাকায় হবে আশুলিয়া আবাসন প্রকল্প। এসব এলাকায় বেশকিছু ঘরবাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানা, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, পিকনিক স্পট, আবাসন প্রকল্পসহ প্রভৃতি অবকাঠামোও রয়েছে।
এসবের প্রায় সবই জলাভূমি ভরাট করে তৈরি হয়েছে। তুরাগের সাভার অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে মসজিদ, ঘরবাড়ি, মার্কেট প্রভৃতি। ওই এলাকায় রাজউকের আবাসন প্রকল্প হলে সমগ্র এলাকার যেমন পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে, তেমনি আশপাশের এলাকাগুলোরও উন্নয়ন হবে। বিদ্যমান জলাশয়ও রক্ষা হবে।
জানা গেছে, মিরপুরের নবাবেরবাগ, দিয়াবাড়ী, সাভারের সাঁতারবাড়ি, চন্দ্রনারায়ণপুর, শিবপুর, কাউন্দিয়া, বাঘসাঁতরা, বনগাঁ, বেরাইদ, গেণ্ডারিয়া, চাকুলিয়া, বিরুলিয়া, আশুলিয়ার দেনুয়া, বিনোদপুর, প্যারাগাঁও, ভাসান, গুশুলিয়া, গুটিয়া, পালাসনা, জিরাব ও বাসান মৌজায় বাস্তবায়িত হবে আশুলিয়া আবাসন প্রকল্প।
ইতোমধ্যে আইডব্লিউএমকে (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) দিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে করা হয়েছে। এ প্রকল্পের ৭১ শতাংশ এলাকায় থাকবে জলাশয়। বাকি ২৯ শতাংশে হবে প্লট, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, মার্কেট, তারকা হোটেল প্রভৃতি। জলাশয় ছাড়া বাকি ৯ হাজার একরেরও কিছু বেশি এলাকা নিয়ে এটি হবে জলাধারভিত্তিক ভিন্ন ধরনের একটি প্রকল্প। এজন্য যেসব জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো অধিগ্রহণ করে সেখানকার কিছু অংশে প্লট হবে। বাকি এলাকায় জলাশয় ফিরিয়ে আনা হবে।