দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখে বিদেশী কূটনৈতিকরা সন্তুষ্ট। এ কারণে তাদের দৌড়ঝাপ কমে গেছে। এদিকে নির্বাচনমুখী দলগুলোর তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা। তবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি শিবিরে হতাশা নেমে এসেছে।
ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠুু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ করতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপ ও কঠোর নজরদারি রয়েছে। সাংবিধানিক শপথ রক্ষায় নির্বাচন কমিশনেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যা কিছু দরকার তার সবই করছে ইসি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ইতোমধ্যেই কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে যে কোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ইসিকে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এবার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অনেক বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। এর মধ্যে রয়েছে সকল রাজনৈতিক দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর সাড়ে ৭ লাখ সদস্য নিয়োগ, ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করা, ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আচরণবিধি মানাতে ৮০২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, যারা ২৮ নভেম্বর কাজ শুরু করবেন।
এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। সংশ্লিষ্ট আসনে প্রার্থীদের অপরাধ তদন্ত করে আমলে নেওয়ার জন্য এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা পর্যন্ত এ কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। এই কমিটিতে যুগ্ম-জেলা জজ, প্রয়োজনে সিনিয়র সহকারী জজ দায়িত্ব পালন করবেন। আর যারা ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এমন পদক্ষেপ দেখে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১২ দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসবেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা এক সময় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দৌঁড়ঝাপ করেন। তারা নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় গিয়ে সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাওয়ার পাশাপাশি কিভাবে এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। এছাড়া তারা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দৌঁড়ঝাপ করে। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ একে একে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন দল ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা রাজপথের বিরোধী দলের সঙ্গে যখনই বৈঠক করেছে তখনই তারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, সরকারের মন্ত্রী বা সচিব এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে তাদের জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া হয়।
প্রথমদিকে সরকারি দল ও বিরোধী দলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শুনে তারা বিব্রত হলেও আস্তে আস্তে সবই পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ, সরকার ও নির্বাচন কমিশন থেকে সব সময়ই বলা হয় সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যা যা প্রয়োজন তা করা হবে। এক পর্যায়ে বিদেশী প্রতিনিধি কূটনীতিকরা ইসির সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ দেখে সন্তুষ্ট হয়। সম্প্রতি ইসির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সবকিছু জেনে কমনওয়েলথের একটি প্রতিনিধি দল সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ্যেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, তৃণমূল বিএনপি, সম্মিলিত মহাজোট ও বিকল্পধারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণ করে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে। এরইমধ্যে শুরু হয় নির্বাচনের আগে জোট-মহাজোট করার প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী শুরু হয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ। এর ফলে সারাদেশ নির্বাচনমুখী হয়। এ পরিস্থিতি দেখে বিদেশী কূটনীতিকদের বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে আগের নেতিবাচক মনোভাব ইতিবাচক হয়। মোড় ঘুরে যায় সার্বিক পরিস্থিতির।
অপরদিকে আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনমুখী না হওয়ায় রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এখন বিভিন্ন মহলের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন। এছাড়া তাদের ধারাবাহিক আন্দোলন চলাকালে জ্বালাও-পোড়াওসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটায় এর দায়ভার বিএনপিরই পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে সহিংসতায় আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপি। এই চিঠিতে ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে আন্দোলন চলাকালে সহিংসাতার দায় সরকারের ওপর চাপানো হয়। এ ছাড়া অতিসম্প্রতি মার্র্কিন দূতাবাসের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। রুমিন ফারহানা আন্দোলন চলাকালে অগ্নিসংযোগ ও সংঘাত নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে। এতে বলা হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যারা বাধা দেবে তাদের ভিসা দেওয়া হবে না। এই ভিসানীতি ঘোষণার পর দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দল, সরকারের মন্ত্রী, সচিব, নির্বাচন কমিশন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শতাধিক বৈঠক করে। এ সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠে এবং কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি আন্দোলনও চালিয়ে যেতে থাকে।
প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধি দলগুলো ঢাকা সফর শেষে ফিরে যাওয়ার সময় সংবাদ সম্মেলন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি। এতে বিএনপি আশাহত হয়ে রাজপথে আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়। দলটির নেতারা মনে করেছিলেন, আন্দোলন ও বিদেশীদের তৎপরতায় জাতীয় নির্বাচনের আগে যে কোনো সময় পরিস্থিতি মোড় নিতে পারে। তবে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পন্ড হওয়ার পর বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করলেও সে আন্দোলন সফল না হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায়।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে আসা পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণে আসার আগে বিএনপির দাবির প্রতি কিছুটা নমনীয় থাকলেও পরে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। এখন তারা মনে করছে, নির্দলীয় সরকার নয়, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী অবস্থানে থেকে নিরপেক্ষভাবে প্রশাসনকে দায়িত্বশীল করার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আগে বিএনপি কূটনৈতিকদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য দিলে তা আমলে নিয়ে যেভাবে দৌঁড়ঝাপ শুরু করত এখন আর তা সেভাবে করছে না। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অনেক দল অংশ নেওয়ায় এবং সারাদেশে নির্বাচন জমে ওঠায় বিদেশীদের ধারণাও পাল্টে গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠুু নির্বাচনের জন্য এখনো চেষ্টা করলেও আগের মতো সেভাবে আর করছে না। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসে এখন পর্যন্ত তারা সন্তুষ্ট রয়েছে। তবে তারা ভোটের দিন পর্যন্ত পরিবেশ অনুকূলে থাকে কি না সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।