২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৬:৪২:৩৯ পূর্বাহ্ন


সন্তানের উপর রাগ করে বাড়ি ছাড়া হয়ে রাস্তায় মা!
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৩-২০২২
সন্তানের উপর রাগ করে বাড়ি ছাড়া হয়ে রাস্তায় মা! সন্তানের উপর রাগ করে বাড়ি ছাড়া হয়ে রাস্তায় মা!


৭০ বছর বয়সী অসুস্থ এক নারী রাবিয়া।তার বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলায়। খেটে খাওয়া তিন ছেলে থাকলেও দুমুঠো ভাতের জন্য তাঁকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এক ছেলের হাতে মার খেয়ে মনের দুঃখে, রাগে-অভিমানে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। অসুস্থ অবস্থায় রোববার দুপুর ১২ টার দিকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভর্তি হয়েছেন তিনি। হাসপাতাল সড়কের পাশে এক চায়ের দোকানের পিছনে শনিবার রাতে অসহায় অবস্থায় পিচবোর্ডের কার্টনের উপর বসে থাকতে দেখে জহিরুল ইসলাম নামে এক সমাজসেবী রায়হান আলী নামের এক অ্যাম্বুলেন্স চালকের সহায়তায় রাতে হাসপাতালের বারান্দায় রেখে যান। পরদিন রোববার রাবিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করান তাঁরা।

জহিরুল ইসলাম প্রতিবেদকে বলেন, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই এলাকায় তিন-চারদিন থেকে মানবেতর অবস্থায় ছিলেন রাবিয়া। এর আগে তিনদিন ছিলেন স্টেশনের প্ল্যাটফরমে। সেখান থেকে চলে যেতে বলা হলে তিনি হাসপাতালের দিকে চলে আসেন। মানুষের সাহায্যেই তাঁর দিন চলছিল।

অর্থপেডিকস বিশষজ্ঞ চিকিৎসক ইসমাইল হোসেন সোমবার দুপুরে বলেন, বছর খানেক আগে দুর্ঘটনায় এক পায়ের দু স্থানে ভেঙ্গে যায় রাবিয়ার। চিকিৎসায় ভাঙ্গা হাঁড় জোড়া লাগলেও ঠিকমত হয়নি। হাঁটতে পারে না ভালো মত। পায়ের ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনি। অপুষ্টিজনিত দুর্বলতাও আছে। এক্স-রে করে দেখা গেছে, ভাঙ্গা পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকদিন হাসপাতালে রেখে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। স্যালাইন, ভিটামিন ইত্যাদি দিতে হবে যেন শরীরে শক্তি পায়।রোববার রাত আটটার দিকে হাসপালের ছয়তলার অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে ভর্তি রাবিয়ার কাছে গেলে তিনি মেলে ধরেন তাঁর দুঃখের গল্পের ঝাপি। দীর্ঘ সেই করুণ গল্প। কথা তাঁর থামতেই চায় না।

রাবিয়া জানান, একবছর আগে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় তাঁর পা ভেঙ্গে যায়। তখন সহানুভূতিশীল এক প্রতিবেশী, কলেজ শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহর কাছে জমা রাখা এক লাখ টাকা পর্যায়ক্রমে তিন ছেলেকে দিয়েছেন। তিন ছেলের কাছেই খেয়েছেন। তাঁর পায়ের চিকিৎসার জন্য মাত্র ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পা ভাঙ্গার পরই তিনি কেবল ছেলেদের কাছে খেয়েছেন। তার আগে তিনি ভিন্ন থাকতেন। নিজের খরচে রান্না করে খেতেন। তাঁর টাকাতেই তাঁকে খাওয়ানো হয়েছে। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, তাই তাঁরা আর খাওয়াতে পারবে না বলছে। সবশেষে বড় ছেলে রিক্সাভ্যান চালক মো. সলিলের বাড়িতে ছিলেন তিনি। পেটপুরে তিনবেলা খাবারও দেওয়া হত না তাঁকে। ভাতের জন্য খোটা দেওয়া, বকাঝকা, এমনকি গায়ে থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কাও দিত বড় ছেলে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ারও কথা বলতো প্রায়ই।

তিনি আরো বলেন, সাতদিন আগে সোমবারের দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে না খেয়ে ছিলাম। বেলা ১০-১১ টার দিকে ভাত খাইতে চেয়েছি। এতেই বকাঝকা শুরু করে দিল সলিল। বলল, ৫০ টাকা কেজি চালের ভাত খাচ্ছি। তোকে আর ভাত দিতে পারবো না। এক থাপ্পর দিয়ে ধাক্কা দিল বলল বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। মনের দুঃখে পোটলা নিয়ে বাহির হয়ে গেলাম। তাও ওই কিছু বলল না। ভ্যান নিয়ে বাহির হচ্ছি। বললাম, একটু মোড়ে নামিয়া দে। তাও দিলো না। বললাম, তুই এমন ছেলে! মাকে লিলি না। অন্যজনের ভ্যানে ওঠে  মুন্ডুমালা হয়ে আমনুরা হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেলস্টেশনে আসলাম।

কথা বলতে বলতে বার বার চোখ মোছেন রাবিয়া। বলেন, বড়ই আঘাত পেয়েছি বাবা।

আর ছেলেদের কাছে যাব না।

জীবনের করুণ কাহিনী বলতে গিয়ে তিনি জানান, ৫০ বছর আগে চার শিশু সন্তানসহ স্ত্রী রাবিয়াকে রেখে মারা যান তানোরের দেবিপুরের বাসিন্দা মো. সদু। রাবিয়া তখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গৃহকর্মী ও তানোরের একটি ব্যাংক কর্মকর্তাদের রাঁধুনির কাজ করে তিন ছেলে ও এক মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিয়েছন। অনেক অনেক দিন নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছেন। সেই তাঁকেই কিনা না খাইয়ে রাখে সন্তানরা। করে মারধর!এসময় তিনি বলেন, তখুন অনেক ভাতের কষ্ট ছিল। বাড়ি বাড়ি কাম কর‌ে ভর‌া ভাত লিয়া আসতুন।ছেলেরা খাইতে খাইতেই শেষ হয়ে যাইতো। আমি না খেয়ে থাকতো।

মুঠোফোনে কথা হয় রাবিয়ার মেজ ছেলে ফজর আলীর সঙ্গে। তিনি ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে তাঁদের খাওয়ানোর কথা স্বীকার করেন। তবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার দিন বড় ভাই মাকে মেরেছিল এ কথা অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, মাও রাগী লোক। বড় ভাইও রাগী। টকঝক হতে হতে বড় ভাই বাড়ি থেকে বাহির হয়ে যেতে বলি, মাও রাগ কর‌ে বাহির হয়ে গেছে। তবে সাত মাস আগে মায়ের পায়ে বড় ভায়ের লাথ লেগে যায়। এ নিয়ে সালিস-বিচারও হয়েছে। বিচারে বড় ভাই মায়ের হাত ধর‌ে মাফও চাইছে।

বড় ভাই সলিলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি বড় ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে মুঠোফোনে বলেন, ভাই বাড়িতে নাই। তিনি ফোনটি ভাইয়ের ছেলে হযরতকে ধরিয়ে দেন। হযরত বলে, বাবা দাদিকে মারেনি। দাদি প্রায়ই ভালোমন্দ খাইতে চাহে। হামরা গরিব মানুষ। কোথায় পাবো। বাবা বলছে, ভালোমন্দ যেখানে খাইতে পাবি, সেখানে যা। দাদি রাগ কর‌ে বাহির হয়ে চলে গেছে।

প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ'র কাছে রাবিয়ার বর্ণনা করা কাহিনী জানানো হয়। তিনি বলেন, রাবিয়ার এ কাহিনীর সত্যতা আছে। আমার কাছে জমা করা এক লাখ টাকা পর্যায়ক্রমে তিন ভাইকেই দিয়েছি। তাতে রাবিয়ারও সম্মতি ছিল। এ টাকা রাবিয়া নিজের গরু-বাছুর বিক্রি ও মানুষের কাছ থেকে পেয়ে জমিয়েছিল। বিশ্বাস করে আমার কাছেই টাকা রাখতো। গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে তিনি ছেলেদের থেকে ভিন্ন হয়ে নিজেই রান্না করে খেতেন। এক বছর আগে পা ভেঙ্গে যাওয়ার পর ছেলেদের কাছে থাকতে লাগলেন। এখন জমানো টাকা ফুরিয়ে গেছে। ছেলেদের কাছে রাবিয়ার কদরও ফুরিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ফজর আলী তাঁর মাকে সলিলের মারধরের কথা স্বীকার করেছেন। আমি আজ (সোমবার) সকালে গ্রামের একজন মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে সলিলের বাড়ি যায়। তাঁর মোবাইল নম্বর চেয়ে তাঁকে বলি, সাংবাদিক তোমার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু তিনি মোবাইল নম্বর দিতে ও কথা বলতে অস্বীকার করেন।

রাজশাহীর সময় / জি আর