২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ০৪:০০:১১ অপরাহ্ন


জেরুজালেমের যে শহরের বাসিন্দাদের ঘন পেটের রোগ হত !
রিয়াজ উদ্দিন:
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৫-২০২৩
জেরুজালেমের যে শহরের বাসিন্দাদের ঘন পেটের রোগ হত ! জেরুজালেমের যে শহরের বাসিন্দাদের ঘন পেটের রোগ হত !


মাটি খুঁড়ে সুপ্রাচীন শৌচাগারের ধ্বংসাবশেষ পেয়েই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। প্রাচীন শৌচাগারই ইঙ্গিত দেয় হাজার হাজার বছর আগে ঠিক কেমন জীবনযাপন করতেন সেই দেশের বা শহরের বাসিন্দারা। সম্ভবত লৌহ যুগের কথা। সেই সময়ের দুটি শৌচাগারের নির্দশন মিলেছে মাটির তলা থেকে। কম করেও আড়াই হাজার বছরের পুরনো। শৌচাগারের গঠন, তার ব্যবহার পদ্ধতিতে কৌতুহল জাগলেও গবেষকদের অবাক করেছে আরও একটি বিষয়। শৌচাগারের কাঠামো, সেখান থেকে পাওয়া বর্জ্যের জীবাশ্মের মধ্যে পাওয়া গেছে নানারকম জীবাণু। এখনকার সময় পেট খারাপের কারণ যেসব জীবাণু, হাজার হাজার বছর আগেও তারা দাপিয়ে বেড়াত এই শহরগুলিতে।

এই খোঁজ জেরুজালেমের। পবিত্রতার পীঠভূমি বলা হয় এই শহরকে। এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যে ভূমধ্যসাগর ও মৃত সাগরের মধ্যবর্তী যোধাইয়ান পর্বতের মালভূমিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নগরী। ঐতিহ্যময় এই শহর থেকেই শুরু খ্রিস্টধর্মের জয়যাত্রা। যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মাত্র চার দশক পরই ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের উদ্‌ভ্রান্ত প্রতাপের চোটে চুরমার হয়ে যায় জেরুজালেম, রোমান রাজপুত্র টাইটাস ভয়ঙ্কর আঘাত হানেন শহরের উপর। লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে কেটে টুকরো করে, পুড়িয়ে খাক করে, জ্যান্ত শরীর টেনে ছিঁড়ে ফেলে প্রকাশিত হয় পরাক্রম। জেরুসালেমের জনসংখ্যা ৫,০০০ বছরের ইতিহাসে বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকেই জেরুজালেমের পুরানো শহরটি ইহুদি,মুসলিম,খ্রিস্টান এবং আর্মেনিয়ান এই চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যে জায়গায় খননকার্য চালিয়েছেন, সেখানে ৮ থেকে ২৫ হাজার মানুষের বাস ছিল একটা সময়। মধ্যবিত্ত যাপনের পাশাপাশি বড় বড় ইমারতও ছিল। শৌচাগারের কাঠামোও সেই আভাস দেয়। চারকোনার চুনাপাথরের মধ্যে টুকরো করে তৈরি শৌচাগারের নির্দশন অনেক পাওয়া গেছে। এর নীচেই রয়েছে সেপটিক ট্যাঙ্ক। এই ধরনের শৌচাগার সমাজের উচ্চবিত্তরাই ব্যবহার করতে বলে অনুমান প্রত্নতাত্ত্বিকদের। 

ইজরায়েল অ্যান্টিকস অথরিটি কিছুদিন আগেই জানিয়েছিল, জেরুজালেমের সিটি অফ ডেভিড আর্কিয়োলজিক্যাল সাইটে চালানো এক প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষণায় সন্ধান মিলেছে দুটি শৌচাগারের। ইসরায়েল অ্যান্টিকস অথরিটির মতে, আসিরিয়ানদের দ্বারা জুডাহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার আগেই নির্মিত হয়েছিল শৌচাগারগুলি।

এই সিটি অব ডেভিড জেরুজালেমের (Jerusalem) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ধর্মীয় বিশ্বেস ভরপুর একটা এলাকা। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে ‘ফার্স্ট টেম্পল’ তৈরি হয়েছিল কিংবদন্তি রাজা ডেভিড ও তাঁর পুত্র সলোমনের হাতে। কিং সলোমনের কথা আমরা জানি। এও জানি যে সলোমনের বাবা ডেভিড হলেন বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর সবচেয়ে রঙিন ও সবচেয়ে শক্তিমান চরিত্র। প্রাচীন শহরটির মধ্যে জায়ন ও টেম্পল মাউন্ট নামে যে দু’টি রহস্যময় পাহাড়, যেখানে নাকি সেই কবে থেকেই দৈবী শক্তির ভরকেন্দ্র, সেখানে দুর্গ তৈরি করেছিলেন ডেভিড। আর তার পর থেকেই জেরুসালেমের পাহাড়ি প্রাসাদ-ঘেরা মধ্যস্থলটির নাম হয়ে গিয়েছিল সিটি অব ডেভিড। আজ তিন হাজারেরও বেশি বছর ধরে লক্ষ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে রয়েছে এই জায়গার সঙ্গে। এই সিটি অব ডেভিডেই প্রাচীন জেরুজালেমের অনেক রহস্যের খোঁজ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক-গবেষকরা।

শৌচাগার দুটির খোঁজ যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার থেকেও বেশি কৌতুহল ছিল সে সময় সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, তাদের অসুখবিসুখের ধরন নিয়ে। তাই শৌচাগার দুটি থেকে নমুনা নিয়ে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের গবেষকরা। তাতেই বেরিয়ে আসে আশ্চর্য তথ্য। জানা যায়, সে সময়ের জেরুজালেমের লোকজন জিয়ার্ডিয়া ডুওডেনালিস রোগে বেশি ভুগতেন। জিয়ার্ডিয়াসিস হল একরকম পরজীবী যা মানুষ ও অন্যান্য পশুর ক্ষুদ্রান্তে বাসা বাঁধে। এই জীবাণু পেটে সিস্ট তৈরি করে যা মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। প্রাচীন শৌচাগার থেকে পাওয়া বর্জ্যের জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বোঝা গেছে, বেশিরভাগই এই পরজীবীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঘন ঘন ডায়রিয়া, ডিহাইড্রেশন হত সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের। নানারকম কৃমিও পাওয়া গেছে মানুষের বর্জ্যের নমুনায়। টেপওয়ার্ম, রাউন্ডওয়ার্ম, পিনওয়ার্ম, হুইপওয়ার্মের খোঁজ মিলেছে।

গবেষকরা বলছেন, পেটের মারাত্মক অসুখে ভুগতেন জেরুজালেমের বাসিন্দারা। এর কারণও আছে। একটা সময় জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েছিল এই শহরে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রার পারদও চড়েছিল। জলবায়ুর বদল, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানীয় জলের অভাব নানা অসুখবিসুখ বাড়িয়ে তুলেছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনা উত্থান নানা কারণে চরম অস্থির সময়ের মধ্যে যাচ্ছিল জেরুজালেম। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার ধরনেও বদল এসেছিল সে সময়। গবেষকদের অনুমান, নানা ক্রনিক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছিল। জিয়ার্ডিয়ার মতো রোগ মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল একটা সময়।