২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ০১:২৯:৩১ অপরাহ্ন


বিষাক্ত অ্যাসিডের ব্যাটারি পোড়ানো হচ্ছে ফসলি জমিতে
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০২-২০২২
বিষাক্ত অ্যাসিডের ব্যাটারি পোড়ানো হচ্ছে ফসলি জমিতে বিষাক্ত অ্যাসিডের ব্যাটারি পোড়ানো হচ্ছে ফসলি জমিতে


প্রায় অর্ধেক দামে কিনে নেওয়া হয় অটোরিকশা ও চার্জার ভ্যানের পুরাতন ব্যাটারি। এরপর ব্যাটারিতে থাকা পার্টস খুলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর তা পুনরায় নতুন ব্যাটারিতে ব্যবহার করা হয়। পুরাতন ব্যাটারি থেকে বিষাক্ত অ্যাসিডের সিসা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এসব ব্যাটারি থেকে বের করা বিষাক্ত অ্যাসিড ও আগুনে পোড়ানো বিভিন্ন পদার্থের কুণ্ডলী থেকে বের হওয়া সিসায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কারখানার পাশের ফসলি জমি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের বাবু ডাইং-কেন্দুল রাস্তার ধারে ফসলি জমিতেই গড়ে উঠেছে পুরাতন ব্যাটারির কারখানা। এসব ব্যাটারির বিষাক্ত অ্যাসিড ও ধোঁয়ায় পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে আশেপাশের সরিষা, মসুরসহ বিভিন্ন ফসল। অনুমোদন ছাড়াই ফসলি জমির মাঠে এমন স্পর্শকাতর পদার্থের কারখানা গড়ে তোলায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তা বন্ধের দাবি স্থানীয় কৃষকদের। 

স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকরা বলছেন, জনবসতিহীন এলাকা হওয়ায়র সুযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক ব্যাটারি ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় এই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ের মেসার্স আশরা অটো ও কাজল ব্যাটারি সার্ভিসিং সেন্টারের মালিক ব্যাটারি ব্যবসায়ী খুরশেদ আলম কাজল এই কারখানার মালিক। এ ছাড়া গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর ও মহসীন নামে আরও দুইজন মালিক রয়েছে কারখানাটির। 

এক বছরের জন্য ১৮ কাঠা জমি ইজারা নিয়ে চারদিকে ত্রিপাল দিয়ে ঘিরে ফসলি জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে কারখানা। স্থানীয়রা জানায়, রাত গভীর হলেই পোড়ানো হয় পুরোনো ব্যাটারির বিভিন্ন পদার্থ। আগুনে পুড়িয়ে পুরাতন ব্যাটারি থেকে ভেতরের সিসা বের করা হয়। পরে এসব পোড়া ব্যাটারির নির্গত সিসা ও অন্যান্য পদার্থ পুনরায় ব্যাটারি তৈরির কারখানায় বিক্রি করা হয়। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাতে যখন ব্যাটারি জ্বালানো হয়, তখন আশপাশের ৩ কিলোমিটার জুড়ে বিষাক্ত ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এমনকি ইতোমধ্যে আশেপাশের ফসলি জমিতে অ্যাসিড ছড়িয়ে পড়েছে। জমির মালিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নামোশংকরবাটি গুমপাড়ার মিজান। গত ৩ মাস আগে মিজানের এই জমিতে পুরাতন ব্যাটারির কারখানা করা হয়েছে। এতে ফসলি জমির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা। 

কারখানার পাশেই ১২ বিঘা ফসলি জমি রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নিমগাছি সরকারপাড়া এলাকার মৃত আবু তালেবের ছেলে আতাউর রহমান বলেন, এটা স্থাপনের ফলে আমার সরিষা পুড়ে গেছে। এমনকি আশেপাশের সকল জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ফসল নষ্ট হচ্ছে। তাদেরকে বলতে গেলে তারা বলছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করা আছে। তোমাদের যা ইচ্ছে করো। 

সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের কেন্দুল গ্রামের কৃষক বশির উদ্দিন জানান, রাতের বেলা পুরোনো ব্যাটারিতে আগুন দেওয়া হয়। সেসময় বিশাল কুণ্ডলী তৈরি হয়। ব্যাপক গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে ওঠে বাতাস। শুনলাম তারা এক বছরের জন্য চুক্তি করে এই ফসলি জমি নিয়েছে। এসব কাজ করতে থাকলে এই এলাকার সব ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। দ্রুত এই কারখানা উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। 

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে কৃষি জমিতে কোনো ধরনের কলকারখানা করা যাবে না। অথচ এখানে ব্যাটারির অ্যাসিড বের করা, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খোলা ও ব্যাটারি পোড়ানোর মতো কাজ করা হচ্ছে। নিজের ব্যবসায়ের স্বার্থে কৃষি জমি ও পরিবেশের ক্ষতি হলেও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। 

জানা যায়, পুরাতন ব্যাটারির এই কারখানায় কাজ করা বেশিরভাগ লোক নওগাঁ, বগুড়া, গাইবান্ধার। তারা ব্যাটারির সকল যন্ত্রাংশ খুলে আলাদা করে ও ব্যাটারি পুড়িয়ে তা বগুড়ায় পাঠায়। সেখানে নতুন ব্যাটারিতে পুনরায় এসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়। শ্রমিকরা বলছেন, এখানে দৈনিক ১০০-১৫০টি ব্যাটারির যন্ত্রাংশ খোলা ও আগুনে পোড়ানো হয়।

বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অ্যাসিডের কাজে কর্মরত শ্রমিকদের সর্তকতা নেই বললেই চলে। মুখে মাস্ক ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা। 

শ্রমিক আনোয়ার আলী জানান, পুরাতন ব্যাটারিগুলো খুলে যন্ত্রাংশগুলো আলাদা করা হয়। রাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে তা থেকে বিশেষ পদার্থ তৈরি করা হয়। অ্যাসিডের বিষয়ে তিনি বলেন, আশেপাশেই গর্ত করে অ্যাসিডগুলো রাখা হয়। তবে গড়িয়ে গড়িয়ে তা আশেপাশের জমিতেও যায়। কিন্তু এর তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। 

জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ে পুরাতন ব্যাটারি ক্রয় করেন সুমন আলী বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা ব্যাটারি ক্রয় করি। পরে সেগুলো ঢাকা, নওগাঁ, বগুড়াতে পাঠায়। তবে সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জেও এখন একটি কারখানা হয়েছে। সেখানেই পুরাতন ব্যাটারি খুলে প্রক্রিয়া করা হয়। এ সময় আগুনের কুণ্ডলীতে থাকা ধোঁয়ায় আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমাকে বিভিন্ন জেলার কয়েকজন ব্যবসায়ী এই কারখানা করার প্রস্তাব দিলেও পরিবেশের কথা ভেবে তাতে রাজি হয়নি। 

মেসার্স আশরা অটো ও কাজল ব্যাটারি সার্ভিসিং সেন্টারের মালিক খুরশেদ আলম কাজল বলেন, সারাদেশের সব জায়গায় এভাবেই পুরাতন ব্যাটারি প্রক্রিয়া করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমিই প্রথম এটা নিয়ে এসেছি। যখন কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছিল, তখন মাঠে ফসল ছিল না। তবে এখন কারো ক্ষয়ক্ষতি হলে, তার ক্ষতিপূরণ দিব। কারখানা স্থাপনের বিষয়ে কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই বলে জানান তিনি। 

নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক ফাউজিয়া তাবাসসুম বলেন, অটোরিকশার ব্যাটারিতে সালফিউরিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফসলি জমির পাশাপাশি মানবদেহের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এসব অ্যাসিডের প্রভাবে ক্যান্সার, কিডনির বিভিন্ন সমস্যা, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কারয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, ফসলি জমিতে যেকোনো ধরনের অ্যাসিডের কারণে মাটির পিএইচ বেড়ে যায়। এতে মাটি অতিরিক্ত ক্ষারীয় হয়ে যায়। ফলে গাছপালা মাটি থেকে তার খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। গাছের ফলন হয় না এবং গাছ বাড়েও না। 

জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমন কোনা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কৃষি জমির ক্ষতি করে এভাবে ব্যাটারির অ্যাসিডের কারখানা করতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। 

রাজশাহীর সময় /এএইচ