২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৩:৫৮ অপরাহ্ন


মানুষের প্রতি সুধারণা ইবাদতের অংশ
ধর্ম ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৫-২০২৩
মানুষের প্রতি সুধারণা ইবাদতের অংশ ফাইল ফটো


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘যারা মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমান এনেছ, অথচ এখনও অন্তঃকরণে ঈমান পৌঁছেনি! তোমরা মুসলিমদের নিন্দা করো না, তাদের ছিদ্রান্বেষণ করো না। কেননা, যে ব্যক্তি অপরের দোষ খোঁজে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আর আল্লাহ যার দোষ তালাশ করেন, তাকে তার নিজের ঘরেই অপদস্থ করেন।’ (আবু দাউদ ৪৮৮০)

কোনো মুমিনই মন্দ ধারণা পছন্দ করেন না। মনে তেমন কোনো ধারণার উদ্রেক হলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। অন্য হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মনের মধ্যে এমন কিছু চিন্তার উদ্রেক হয়, যা সূর্য উদিত হওয়ার পরিধির মধ্যকার (মূল্যবান) সব কিছুর বিনিময়েও প্রকাশ করা আমরা সমীচীন মনে করি না। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কি তা অনুভব করো? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এটিই ঈমানের সুস্পষ্ট পরিচয়।’ (আদাবুল মুফরাদ)

ইসলামে কারও প্রতি খারাপ ধারণার সুযোগ নেই। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মানুষের প্রতি সুধারণা পোষণ করতেই উৎসাহিত করেছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা মানুষকে ধারণা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়ে বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ

 ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান পাপ।’ (সুরা হুজরাত: আয়াত ১২)

আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘যখন তারা এটা শুনল, তখন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীরা আপন লোকদের সম্পর্কে কেন ভালো ধারণা করল না এবং বলল না, এটা তো নির্জলা অপবাদ। ’ (সুরা নুর: ১২)

মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ভাই ভাই। তাই ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের মন্দ ধারণা পোষণ করার কারণে ভ্রাতৃত্ববোধ কলুষিত হয়। এই কুধারণা থেকেই পাপ সংঘটিত হয়। তাই কোনো বিষয়ে শুধুমাত্র ধারণা করাকে ‘বড় মিথ্যা’ বলে ঘোষণা করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا

‘তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কেননা তা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তোমরা দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পর হিংসা পোষণ করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না এবং পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়ো না; বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি ৬০৬৪)

পক্ষান্তরে, অন্যের ব্যাপারে উত্তম ধারণা করা সওয়াবের কাজ। এটি ইবাদতের অংশ। তাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যের প্রতি উত্তম ধরণা করে ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন এভাবে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

حُسْنُ الظَّنِّ مِنْ حُسْنِ الْعِبَادَةِ

‘উত্তম ধারণা পোষণা করা উত্তম ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ ৪৯৯৩)

এ কারণেই কোনো মুসলমানের প্রতি অনুমান নির্ভর দলিল-প্রমাণ ছাড়া কোনো বিষয়ে কোনো কথা বলা ঠিক নয়। এতে আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাও অপদস্ত হতে পারেন। সমাজে তৈরি হতে পারে বিভক্তি। তাইতো নবিজি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশিকে জ্বালাতন না করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি ৬০১৮)

যারা নিছক অনুমান নির্ভরভাবে নিজেকে পরিচালনা করে পরকালে তাদের কাছ থেকে কঠোরভাবে কৈফিয়ত নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ کُلُّ اُولٰٓئِکَ کَانَ عَنۡهُ مَسۡـُٔوۡلًا

‘আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ৩৬)

কেউ যেন কারও প্রতি মন্দ ধারণা না করে, কেউ যেন মন্দ ধারণার ফেতনায় নিমজ্জিত না হয়, সে জন্য মন্দ ধারণা হতে পারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তা ব্যাখ্যা করে দেওয়াও মুমিনের দায়িত্ব। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাস্তব জীবনের একটি ঘটনা থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায়। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘একবার নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কোনো এক স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। তখন তাঁর কাছ দিয়ে এক ব্যক্তি (সাহাবি) অতিক্রম করলো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ডেকে বলেন, হে অমুক, এ আমার স্ত্রী অমুক। সে বলল, আমি হয়তো কারো সম্পর্কে ধারণা-অনুমান করতে পারি; কিন্তু আপনার সম্পর্কে কখনও ধারণা-অনুমানে লিপ্ত হই না। নবিজি বললেন-

إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنَ ابْنِ آدَمَ مَجْرَى الدَّمِ

‘শয়তান আদম সন্তানের শিরা-উপশিরায় রক্তের ন্যায় প্রবাহিত হয়।’ (আবু দাউদ ৪৭১৯)

মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাকতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি আমল করার নসিহত করেছেন। তাহলো- যথাসম্ভব মন্দ ধারণাকে মনের মধ্যে জায়গা না দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিলেন এরপর বলেন, এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কারো অন্তরে তা (মন্দ ধারণা) অনুভব করলে সে তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। মুমিন ব্যক্তিই এটা অনুভব করে থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ)

মনে রাখতে হবে

মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাকা খুবেই কঠিন কাজ। সাধারণত মানুষের পক্ষে তা প্রায়ই অসম্ভব। তবে যারা তা থেকে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে উদিত হওয়া মন্দ ধারণা বা বিভ্রান্তি ক্ষমা করে দেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

 إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ لِأُمَّتِي عَمَّا وَسْوَسَتْ أَوْ حَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ بِهِ أَوْ تَكَلَّمْ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার উম্মাতের ঐ সব ওয়াস্ওয়াসা ক্ষমা করে দিয়েছেন যা তাদের মনে উদিত হয় বা যে সব কথা মনে মনে বলে থাকে; যতক্ষণ না তা বাস্তবে করে বা সে সম্পর্কে কথা বলে।’ (বুখারি ৬৬৬৪)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অন্যের ব্যাপারে মন্দ ধারণা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। মন্দ ধারণা থেকে সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।